বন্ধুটি বললেন—তা বলতে পারব না মশাই। আমরা তো পরদিন ভোরের গাড়িতেই কলকাতা চলে এলাম। ডাক্তারের নির্দেশে বিভূতিদা থেকে গেলেন। বাকি অর্ধেক কাঁকড়ার খবর বলতে পারব না।
আজ্ঞার আরেক কোণ থেকে একজন প্রশ্ন করলেন-আচ্ছা এই ঘটনার পরে বিভূতিদার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল কি?
হয়েছিল মাস দুই পরে কলেজ স্ট্রীটে। মেদিনীপুরের প্রসঙ্গ নিজে থেকেই তুলে বললেন–তিনদিন বিছানা থেকে উঠতে পারি নি। অবশ্য ওদের দোষ নেই। অসময়ে পুকুরের জাত কাঁকড়া যোগাড় করতে না পেরে ধান ক্ষেতের কাঁকড়া ধরে এনেছিল। তা ছাড়া রান্নটা বড়ই উপাদেয় হয়েছিল রে, তাই লোভে পড়ে মাত্রাতিরিক্ত খেয়ে ফেলেছিলাম।
বিভূতিদাকে নিয়েই আমাদের সেদিনকার বৈঠক সরগরম। মেদেনীপুরের কাহিনী শেষ হতেই কে একজন বলে উঠল–বিভূতিদার মেয়ে দেখে বেড়ানোর গল্পটা শুনেছেন?
গল্প পেলেই বৈঠক যেন টগবগিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে ফরমাশ চা-চাই। এর আগে তিন রাউণ্ড চা হয়ে গেছে তবুও তৃপ্তি নেই। আমার ঘরের বেয়ারা অমর এক কোনায় তার ছোট টেবিলটায় বসে কতকগুলি চিঠি ফাইল করতে ব্যস্ত। দেখতে ছেলেমানুষ, বুদ্ধিতে সেয়ানা। কাজের ভান করে কান দুটো সর্বদা খাড়া রাখে বৈঠকের গল্পের উপর। চায়ের কথা বলতেই অমর বললে—আধ মাইল দূরে চায়ের দোকান। যেতে-আসতে আধঘণ্টা কাবার। তার চেয়ে আমাকে একটা হিটার কিনে দিন আর কয়েকটা পেয়ালা পিরিচ। আমি ঘরে বসে আপনাদের গরম চা করে খাওয়াব। খরচ খাতায় লেখা থাকবে, মাস কাবারে যার ভাগে যা পড়ে হিসেব করে দিয়ে দেবেন।
প্রস্তাবটা সবার ভালই লাগল, সবাই একবাক্যে রাজী। আমি দেখছি ছোকরা ফন্দিটা এঁটেছে ভাল। ব্যবসা-কে ব্যবসা, মনিবেরও পয়সা বাঁচানো ইল। তার চেয়ে বড় কারণ চায়ের জন্য বলতে গিয়ে গল্প থেকে বাদ পড়ে যাওয়া—সেটি আর হচ্ছে না।
অগত্যা চা না আসা পর্যন্ত বিভূতিদাকে আর বৈঠকে আনা গেল না।
চতুর্থ কিস্তির চায়ের কাপে চুমুক মেরে বৈঠকের সেই বন্ধুটি বললেন–বিভূতিদা ঠিক করলেন তার ছোট ভাইয়ের জন্যে একটি পাত্রীর সন্ধান করবেন। বাংলাদেশের প্রত্যেক জিলার শহরে গ্রামে পরিচিত ব্যক্তির কাছে চিঠি চলে গেল। শর্ত শুধু এই, পাত্রীর স্বহস্তে রন্ধন। এবং যে দেশের পাত্ৰী, সে দেশের রান্নার বৈশিষ্ট্যটুকু দেখানোই নির্বাচন-পরীক্ষার একমাত্র মাপকাঠি।
বিভূতিদার ধারণা, ভাল রাঁধুনি না হলে ভাল গৃহিণী হওয়া যায় না।
দিনক্ষণ দেখে বিভূতিদা এক জেলা থেকে আর এক জেলার গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন পাত্রী সন্ধানে। বিভূতিদা ভাল করেই জানতেন যে, পাত্রী সু-রাধুনি হোক চাই না হোক, পাত্রীর মা-দিদিমা ঠাকুরমারা তাদের পাত্রীকে পার করবার জন্য রাঁধুনি-জীবনের অভিজ্ঞতার যাবতীয় এলেম দিয়ে ভক্ত-চচ্চড়ি-ঘন্ট ইত্যাদি রান্না করে পাত্রীর নামেই চালাবেন।
প্রায় মাস-দুই কাল সারা বাংলা দেশ ঘুরে প্রচুর অভিজ্ঞতা নিয়ে বিভূতিদা ফিরলেন। আপনাদের মনে আছে কি না জানি না, সেই বছরের পুজোর সময়ে বিভিন্ন শারদীয়া সংখ্যায় কয়েকটি গল্প বেরিয়েছিল এই পাত্রী দেখানিয়ে, আর কি অসাধারণ সে গল্প। বাঙ্গালী মায়ের অন্তরের বেদনার কী সহজ সরল প্রকাশ।
এইটুকু বলেই বৈঠকী বন্ধুটি সিগারেট ধরালেন। সকলেরই মন ভারাক্রান্ত। সংসারে এক-একজন মানুষ থাকে যাদের বাইরের চালচলন দেখে হাসি পায় বটে, কিন্তু তাদের ভিতরে লুকিয়ে থাকে শিশুর মত সরল ও আপন ভোলা একটি মানুষ যার সংবেদনশীল হৃদয় সংসারের শোক তাপ জ্বালা যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে থেকে গভীর প্রশান্তির মধ্যে বিরাজ করে। এমন একটি খাঁটি জীবন-শিল্পী আজ আমাদের মধ্যে নেই, সে-দুঃখেই মন ভারাক্রান্ত। কিন্তু বৈঠকের সেই কশত সাহিত্যিক, ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যে গুমোট আবহাওয়াকে তরল করতে যার জুড়ি মেলে না, তিনি বলে উঠলেন—আসল কথা কি জানেন? বিভূতিবাবু সত্যিই খেতে ভালবাসতেন। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল খেয়ে দেখা, মেয়ে দেখা ছিল উপলক্ষ্য।
আমাদের বৈঠকের এক অরসিক বন্ধু বললেন–আজ যদি বিভূতিবাবু বেঁচে থাকতেন এবং গল্প-উপন্যাস না লিখে একখানা প্রমাণ সাইজের গবেষণামূলক বই লিখে তার নাম দিতেন বাংলার রান্না ও রাঁধুনী বা পশ্চিমবঙ্গ রন্ধন সংস্কৃতি তাহলে আকাদমী না পেলেও রবীন্দ্র পুরস্কারটা মারে কে।
৬. সাহিত্যিকদের মধ্যে কে কেমন
সাহিত্যিকদের মধ্যে কে কেমন খেতে পারেন সেই আলোচনা-প্রসঙ্গেই কথা উঠল নিশিকান্তর, আমাদের পণ্ডিচেরীর নিশিকান্ত, যার কবিখ্যাতি কাতোর অবিদিত নেই। বৈঠকের বন্ধুরা সবাই আমাকে চেপে ধরলেন ভোজন-রসিক নিশিকান্তর গল্প বলতেই হবে, বিশেষ করে তার খাবার গল্প।
বৈঠকের গাল্পিক বন্ধু বললেন–এই কবি নিশিকান্তই না আপনাকে নেংটি ইঁদুরের মাংস রান্না করে খাওয়াতে গিয়েছিল? সেই ঘটনাটাই আমাদের বলুন!
আমি আপত্তি জানিয়ে বললাম—ইঁদুরের মাংস খাওয়াটা এমন কিছু একটা বাহাদুরির গল্প নয় যা সবাইকে জাঁক করে বলা চলে। কৈশোর জীবনে কতরকম ঝোঁকই না ঘাড়ে চাপে আর কত কুকীর্তিই না করা হয়। সবই কি আর বলা যায়? তবে এটুকু বলতে পারি—ইঁদুরের মাংস সে-শুধু আমাকে একাই খাওয়াবার চেষ্টা করে নি। সঙ্গে আরও দুজন ছিল। টুনাং নামে ছিল একজন কর্মী ছেলে, শান্তিনিকেতন ইস্কুলে সে-ছিল আমার সহপাঠী। দুর্দান্ত ডানপিটে। আর ছিল আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন-এর পুত্র শ্রীক্ষেমেন্দ্রমোহন সেন–যাকে শান্তিনিকেতনের সবাই কঙ্কর নামে চেনে।