আমি বললাম, কেন? সভা সম্পর্কে নিশ্চয়ই। কখন সভা, কী বিষয়ে বলতে হবে ইত্যাদি।
উহুঁ, হল না। তার প্রথম প্রশ্নই ছিল, দুপুরে আহারের বন্দোবস্ত কোথায় হল, কী কী রান্না হয়েছে। প্রশ্নের উত্তরে জানলাম দুপুরে খড়গপুর স্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট কম-এ খাওয়া-দাওয়া সেরে আমাদের মেদিনীপুরের .এক উকিলের বাড়ি অতিথি হতে হবে, কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর বেলা পাঁচটায় সভাস্থলে যাত্রা।
রিফ্রেশমেন্ট রুম-এ খেতে খেতে পাওয়ার গল্পই চলছে, বক্তা বিভূতিবাবু একাই। মেদিনীপুরে খাওয়ার বৈশিষ্ট্য কী তার এক লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে বিভূতিবাবু উদ্যোক্তাদের বললেন–মেদিনীপুরের কাঁকড়ার ঝোল শুনেছি খেতে খুব ভাল। তা কাল তো রবিবার, কাল দুপুরে কাঁকড়ার বোল খাওয়াতে পারেন?
উদ্যোক্তারা এ-হেন ফরমাইশের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু তারাও পেছ-পাও হবার লোক নন। বললেন–আগে খবর পেলে লোক লাগিয়ে ভাল জাতের কাঁকড়া সংগ্রহ করে রাখতাম। তবু যে-করেই হোক কাল আপনাদের কাঁকড়ার ঝোল খাওয়াবই।
রাত্রে আহারাদির পর একটা হল-ঘরে আমরা সবাই শুয়েছি। সবে তন্দ্রা এসেছে, এমন সময় ঘরের এক কোণ থেকে খড়খড় আওয়াজ উঠল। আমি পাশের ভদ্রলোককে ডেকে বললাম-ও মশায়, শুনছেন? ইঁদুরের উৎপাত বলে মনে হচ্ছে। আমাদের মিটিংকা কাপড়া অর্থাৎ সিল্কের পাঞ্জাবি কেটে তছনছ করে দেবে না তো?
বিভূতিদা অন্যদিক থেকে পাশ ফিরতে ফিরতে বললেন—তোর বড় বকরবকর করিস। ঘুমোতে দে। কাল আবার ভোরে উঠে তিন-তিনটে সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটের কবর দেখতে যেতে হবে না, যাদের বিপ্লবীরা খুন করেছিল?
কিন্তু জামা-কাপড়গুলো স্যুটকেস-এ ভরে রাখলে হত না? ইঁদুরের যে-রকম আওয়াজ পাচ্ছি।
বিভূতিদা একটু রাগতস্বরেই বললেন–দেখ, তোরা শহরে থেকে থেকে অমানুষ হয়ে গেছিস। ওটা ইঁদুরের আওয়াজ নয়, কাঁকড়ার।
কাঁকড়া? একসঙ্গে হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসে সবাই বলে উঠল–বিছে নয় তো?
বালিশের তলা থেকে টর্চলাইটটা বার করতে করতে বিভূতিদা বললেন–শহরে থেকে থেকে তোদর আর বুদ্ধিশুদ্ধি হল না। কাঁকড়াবিছের আবার ওরকম খড়খড় আওয়াজ হয় নাকি? ওটা কাঁকড়ার-ঝোলের কাঁকড়া। এই দ্যাখ–
বিভূতিদা টর্চের আলো ফেললেন ঘরের কোণে রাখা একটা ছালার বস্তার উপর। আলো পড়াতে বস্তার ভিতরে জীবগুলি আরও আওয়াজ করে নড়তে লাগল। বিভূতিদা বাতি নিবিয়ে বললেন–দেখলি তো? এখন শুয়ে পড়।
একজন জিজ্ঞেস করলে-এক বস্তা কাঁকড়া কেন বিভূতিদা, তাছাড়া আমাদের শোবার ঘরেই বা এনে কেন রাখল?।
বিভূতিদা ঘুমজড়িতকণ্ঠে বললেন—সারারাত ধরে আমাদের জানান দিতে যে আমাদের জন্যে কাঁকড়া সংগ্রহ হয়েছে। আর এক বস্তা কেন জিজ্ঞেস করছিস? কাল দুপুরে অর্ধেক রান্না হবে আর বাকি অর্ধেক পরশু ভোরে ফেরবার সময় ট্রেনে তুলে দেবে। কাঁকড়ার বোল খেতে চেয়েছিলুম কি-না!
পরদিন দুপুরে খেতে বসে খাওয়া কাকে বলে বিভূতিবাবু তা দেখিয়ে দিলেন। শুধু দেখানো নয়, দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন। নানারকম ভাজাভুজির পর যখন জামবাটির একটি করে কাঁকড়ার ঝোল দিয়ে গেল–শুধু তাকিয়ে দেখলাম বিভূতিদার চোখ-মুখের উল্লসিত ভাব। অন্যসব তরিতরকারি সরিয়ে রেখে কাঁকড়ার ঝোলের বাটিটা টেনে নিয়ে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন তিনি। বাটিটা নিঃশেষ করে হুঁশ হল আমাদের দিকে তাকাবার। আমাদের বাটির ঝোল যেমন-কে-তেমনই আছে দেখে বিভূতিদা বিদ্রুপের সুরে বললেন–শহরে থেকে থেকে তোরা ভাল জিনিস আর ভাল রান্নার কদর বুঝলি না। রেস্টুরেন্টে বসে কতকগুলো ফাউল কটলেট, মটন কটলেট, ব্রেস্ট কটলেট, কবিরাজী কটলেট খেয়ে খেয়ে তোদের রুসনার বিকৃতি ঘটেছে। আরে, ওগুলো তো সব ভেজাল, বিষ।
ততক্ষণে উকিল-গিন্নী বিভূতিদার নিঃশেষিত বাটিটা আবার কাঁকড়ার ঝোলে ভরে দিলেন। বিভূতিদার দিক থেকে আপত্তির কোন লক্ষণই দেখা গেল না।
আমরা আমাদের খাওয়া শেষ করে হাত গুটিয়ে বসে আছি। বিভূতিদার খাওয়া শেষ না হলে আসন ছেড়ে উঠতে পারছি না এবং বেশ বুঝতে পারছি আরও আধ ঘণ্টার আগে ওঠা সম্ভবও হবে না। বিভূতিদা বাটি থেকে একটি একটি করে কাঁকড়া তুলছেন, তার বাড়াটা ভেঙ্গে নিয়ে প্রথমে বেশ খানিকক্ষণ চুষিকাঠির মতন চুষে দাঁত দিয়ে কুটুস করে কামড়ে দাঁড়াটা ভেঙ্গে নিয়ে তার ভিতরের মাংস কুরে কুরে খেতে লাগলেন।
কী পরিষ্কার পরিপাটি খাওয়া! রসিয়ে খাওয়াও যে একটা আর্ট তা বুঝলাম সেদিন বিভূতিদার খাওয়া দেখে।
দ্বিতীয় বাটি শেষ করার পর গৃহকর্মী যখন তৃতীয়বার কাঁকড়ার কোলে বাটি ততি করবার জন্য এগিয়ে এলেন—বিভূতিদা তখন একটা কাঁকড়ার আত খোল মুখে পুরে চিবোত চিবোতে মৃদুস্বরে বললেন—আমায় আর কেন। অগত্যা আবার বাটি ভরতি হল, বিভূতিদা নিশ্চিন্ত মনে কাঁকড়া চিবোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বাধ্য হয়েই আমরা তখন উঠবার অনুমতি চাইলাম। ততক্ষণে কাঁকড়ার ঝোল আমাদের হাতের চেটো আর আঙ্গুলে শুকিয়ে আঠার মত এটে গেছে। বিভূতিদা একটু সলজ্জ হেসে অনুমতি দিলেন। বললেন—তোরা ওঠ। আমার একটু দেরিই হবে। ভাল জিনিস রেখে-চেখে না খেলে আমি তৃপ্তি পাইনে।
এই পর্যন্ত বলেই সেদিনের আন্ডার গাল্পিক বন্ধুটি থামলেন। শুধু বললেন–পরের ঘটনা আর না-ই বললাম, অনুমান করে নিন।
অনুমান আমরা সবাই ঠিকই করে নিলাম। তবু প্রশ্ন উঠল আধ বস্তা হয় রান্না হয়েছিল। বাকি আধবস্তা কাঁকড়া কি সত্যি সত্যিই ট্রেনে তুলে দিয়েছিল?