স্ত্রীবুদ্ধি সম্বন্ধে আরেকবার নিঃসন্দেহ হয়ে গোটা-দুই লুচি মুখে পুরে রওয়ানা হলাম বাগবাজার অভিমুখে।
আনন্দ চ্যাটার্জি লেন-এ তারাশঙ্করবাবুর বাড়িতে যখন উপস্থিত হয়েছি তখন প্রায় নটা বাজে। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দাঁড়ালেন স্বয়ং তারাশঙ্করবাবু। অনাবৃত দেহে শ্বেতশুভ্র উপবীত যেন ঘনকৃষ্ণ মেঘের গায়ে বিদ্দুল্লতা।
প্রণাম করতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন–তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি, এস, এস, বস।
আমাকে চেয়ারে বসিয়েই ভিতরের ঘরের দরজার কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, সনৎ, শীগগির প্লেট নিয়ে আয়, সাগর এসেছে।
তাহলে ডাল-ভাত নয়, জলযোগের ভূরি আয়োজনই হয়েছে অনুমান করলাম। কিন্তু বসতে না বসতেই খেতে হবে? পূজা সংখ্যার লেখা সম্পর্কে কোন কথাই হল না। অথচ আসা মাত্রই খাওয়া? আর, এ খাওয়ানোর উপলক্ষ্যটাই বা কি। প্লেট-এর বন্দোবস্ত যখন, তখন উপলক্ষ্য একটা কিছু আছেই। সেক্ষেত্রে অন্যান্য আমন্ত্রিতরাই বা কোথায়? তারা কি আগেই খাওয়া-দাওয়া সেরে চলে গেল? গৃহিণীর উপর রাগ হতে লাগল। এসেই যদি খেতে বসতে হবে তাহলে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় লুচিই বা গিলতে গেলাম কেন? সাত-সতেরো প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরছে, তারাশঙ্করবাবু তখনও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পরিত্রাহি চেঁচিয়ে বলছেন—
সনৎ, দেরি করছিস কেন? প্লেট-টা তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। কতক্ষণ সাগরকে বসিয়ে রাখব।
খুবই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম আমাকে খাওয়াবার জন্যে ওঁর ব্যস্ততা দেখে। মৃদুস্বরে বললাম
আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন। আসুন গল্পগুজব করি। ওটা পরেই হবে। আমার তো তেমন কিছু তাড়া নেই।
আরও ব্যস্ত হয়ে উনি বলে উঠলেন– না না, সে কি করে হয়। যে-জন্যে তোমাকে ডেকে পাঠালাম আগে সেটা সেরে নাও, পরে গল্প করা যাবে।
কথা শেষ হতে না হতেই তারাশঙ্করবাবুর জ্যেষ্ঠ পুত্র সৌম্যদর্শন সনৎ হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে উপস্থিত, হাতে বৃহদাকারের একটা কালো খাম।
খাম দেখে আমি তো উল্লসিত। যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেছি। পূজা সংখ্যার গল্প তাহলে লেখা হয়ে গেছে? মধুর বিস্ময়ে আমার দুই বিস্ফারিত চোখ খামের অভ্যন্তরে গল্পের পাণ্ডুলিপি দেখবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। পুত্রের হাত থেকে খামটা নিয়েই তারাশঙ্কর বাবু চলে গেলেন পুবদিকের খোলা জানলাটার কাছে। আমাকে বললেন–
জানলার কাছে সরে এস, আলো না হলে দেখতে অসুবিধা হবে।
ওঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তারাশঙ্করবাবু খামের ভিতর হাত ঢুকিয়ে ফস করে টেনে বার করলেন একটা প্লেট। সেই বিখ্যাত প্লেট যার গল্প বহুবার আমাকে অনেক বৈঠকে বলতে হয়েছে, তা আপনাদের আজ শোনাতে বসেছি। খামের ভিতর থেকে একটি এক্স-রে প্লেট বার করে তারাশঙ্করবাবু সেটা চোখের উপর সূর্যকে আড়াল করে মেলে ধরলেন। একটি শীর্ণকায় মানুষের নাড়ীভুড়ি সমেত জট-পাকানো জঠরের ছবি চোখের উপর ভেসে উঠল। মানচিত্রের উপর ছড়ি বুলিয়ে মাস্টারমশাই যেমন ভূগোল পড়ান, প্রায় তেমনি ভাবেই তারাশঙ্করবাবু আঙুল বুলিয়ে আমাকে উদরের ভূগোল শেখাতে লাগলেন। গলার কাছে আঙুল ধরে বলে চললেন—
কণ্ঠনালী দেখতে পাচ্ছ? এই হচ্ছে কণ্ঠনালী। আমরা যখন আহার করি তখন তা এই কণ্ঠনালী দিয়ে পাকস্থলীতে এইভাবে ঘুরে আসছে। ছবির একেবারে তলায় ওটা হচ্ছে পায়ু। পাকস্থলী থেকে খাদ্যবস্তু এখান দিয়ে নিঃসারিত হয়। স্বাভাবিক লোকের পাকস্থলী থেকে পায়ুদ্বারে খাদ্যবস্তু এসে পৌঁছুতে লাগে ছয় ঘণ্টা, আমার লাগছে চার ঘণ্টা। নিজের চোখেই তো দেখলে আমার শরীরের অবস্থা। এক্স-রে করিয়েছি, চিকিৎসাও চলছে, এখন ডাক্তারের কথাতেই দিন-সাতেকের মধ্যে চেঞ্জে যাচ্ছি দাজিলিং-এ। এই অবস্থায় পূজা সংখ্যায় এবার তো লিখতে পারব না ভাই। এমনি বললে তো আর বিশ্বাস করতে না, ভাবতে, আমি ফাঁকি দিচ্ছি। তাই ডেকে পাঠিয়েছিলাম।
জট পাকানো নাড়ী-ভুড়ির ছবি দেখে আমার নাড়ী-ভুড়ি উল্টোবার অবস্থা। অফিসের জরুরী কাজের অছিলায় তখন বেরোবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে বিদায় চাইলাম।
বিস্মিত হয়ে তারাশঙ্করবাবু বললেন—এর মধ্যেই উঠবে কি, এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যাও।
আমি প্রবল আপত্তি জানিয়ে বললাম-না চা আর এখন খেতে পারব। একটু আগেই বাড়ি থেকে পেট ভরে খেয়েদেয়ে বেরিয়েছি।
বাগবাজারের মোড়ের লড়াইয়ে চপের দোকানের সামনে এসে ঢুকব কি না ভাবছি, চোখের উপর ভেসে উঠল সেই এক্স-রে প্লেট। আর কালক্ষেপ না করে বাসেই চেপে বসলাম।
আপনাদের কাছে কবুল করতে লজ্জা নেই, স্ত্রীবুদ্ধি সম্বন্ধে আমার সেই বহুকালের ধারণাটা সেদিনের ঘটনার পর বাধ্য হয়েই বদলাতে হয়েছে।
০৫. শনিবারের আড্ডায় কথা উঠল
শনিবারের আড্ডায় কথা উঠল সাহিত্যিকদের খাওয়া নিয়ে। কোন সাহিত্যিক কি রকম খেতে পারেন তারি আলোচনা প্রসঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা উঠতেই সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেন-হ্যাঁ, খেতে পারতেন বটে বিভূতিবাবু।
বিভূতিবাবুর খাওয়া সম্পর্কে যার যা অভিজ্ঞতা একে একে বলে চলেছেন। একজন বললেন—মেদিনীপুরে একবার এক সাহিত্যসভায় বিভূতিবাবু গিয়েছিলেন সভাপতি হয়ে। চার পাঁচজন সাহিত্যিক কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন, আমিও ছিলাম দলে। শনি-রবি দুদিন থেকে সোমবার সকালে আমাদের ফেরবার কথা। খড়গপুর স্টেশনে নেমে সেখান থেকে মোটর গাড়িতে আমরা যাব মেদিনীপুর। দুপুরে যথাসময়ে ট্রেন খড়গপুর পৌঁছতেই কয়েকজন ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা করতে এগিয়ে এলেন। বিভূতিদা আমাদের দলপতি, তাঁকে এগিয়ে দিয়ে আমরা পিছন পিছন চলেছি। আচ্ছা, আপনারাই বলুন, উদ্যোক্তাদের সঙ্গে তিনি কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলেন?