সে ঘটনা বলি। পাশের বাড়ির সঙ্গে প্রেমেনদার জানলা নিয়ে মামলা চলছে। তুমুল মামলা। পুবদিকের জানলাটির সামনে এক দেওয়াল তুলে দেওয়ায় এই গণ্ডগোল। এখন, আদালতে প্রমাণ দিতে হবে জানলা আগে না দেওয়াল আগে। মামলার পরিণতি যখন একটা চরম নাটকীয় মুহূর্তে উঠেছে, অর্থাৎ কে-জেতে কে-হারে অবস্থা, যথারীতি লেখার তাগাদায় আমি সকালে প্রেমেনদার বাড়ি হাজির। যাওয়া মাত্রই প্রেমেনদা বলে উঠলেন—
তুমি কত বছর ধরে আমার বাড়ি নিয়মিত আসছ?
এ আবার কী প্রশ্ন? তবু মনে মনে হিসেব করে দেখলাম, বারো বছর হয়ে গেল পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। তাই বললাম—
তা, বারো বছর ধরে পূজা সংখ্যায় লেখা আদায়ের জন্য আপনার বাড়ি নিত্য আসা-যাওয়া করছি।
ভেরি গুড। তাহলে বরাবর তুমি পুবদিকের জানলাটা লক্ষ করে এসেছ?
এসেছি। তবে খোলা অবস্থায় দেখি নি কোনদিন।
সোৎসাহে প্রেমেনদা বললেন, যাক নিশ্চিন্ত হলাম। তোমাকে কিন্তু মামলায় সাক্ষি দিতে হবে। আদালতে গিয়ে শুধু বলতে হবে বারো বছর ধরে পুবদিকের জানলাটা ওইখানে ওই অবস্থায় তুমি দেখেছ।
সাক্ষি দিতে তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেলাম। মনে মনে জানি পূজা সংখ্যার লেখা পেতে এবার আর বেগ পেতে হবে না। তাই উৎসাহের সঙ্গে প্রেমেনদাকে যেই-না লেখার কথা বলা আর যাবে কোথায়। চোখ পাকিয়ে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন–
লজ্জা করে না লেখা চাইতে? দেখছ মামলা-মোকদ্দমায় ডুবে আছি। উকিলবাড়ি আর আদালত-ঘর ছুটোছুটি করে মরছি, তার ওপর আবার লেখা?
যেন লেখা চাওয়াটা মস্ত অপরাধ।
আরেকদিন সকালে শারদীয়ার লেখা আদায়ের আশায় তাঁর বাড়ি বসে আছি, আমার মতন আরও চার-পাঁচ জন আছেন। এমন সময় বিখ্যাত একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক এসেই প্রেমেনদাকে বললেন—
ছয় বছর ধরে আপনি আমাকে লেখা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিরাশ করেছেন। এবছর আর ছাড়ছি না। লেখা দিতেই হবে।
উত্তরে প্রেমেনদা বললেন, প্রত্যেক বছরই তোমাকে লেখা দেব বলে ভাবি। কিন্তু এবার বোধ হয় ভাবতেও পারব না।
শারদীয়া পত্রিকার রসদ সংগ্রহের দ্বিতীয় দফা পদ্ধতির উদাহরণ একজন সাহিত্যিককে নিয়েই দিলাম। এরকম ঘটনা অন্যান্যদের নিয়ে যে কত আছে তা আর বলে শেষ করা যাবে না। এর পর হচ্ছে তৃতীয় বা চরম পদ্ধতি। ভোরবেলায় লেখকের বাড়ি গিয়ে অনশন ধর্মঘট করে পড়ে থাকা। কয়েক শিপ লেখা না নিয়ে নড়ছি না। কুঁড়ে লেখকদের কাছে এই পদ্ধতিতেই ফল পাওয়া যায়। একবার লেখায় বসাতে পারলেই হল। তৃতীয় পদ্ধতিতে অবশ্য লেখকদের গৃহিণীরা সম্পাদকের প্রধান সহায় হয়ে থাকেন—এ কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে এখানে উল্লেখ না করলে অপরাধী হতে হবে। ভোর থেকে একটা লোক কুটোটি মুখে না তুলে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে, তাতে যে গৃহস্থবাড়ির অকল্যাণ। তাছাড়া কর্তাকে দিয়ে পূজার সময় লেখানো মানেই ইত্যাদি ইত্যাদি। কাজেই সম্পাদকদের প্রতি সাহিত্যিকের গৃহিণীদের সহানুভূতি চিরকালই থাকে।
প্রেমেন্দ্র মিত্রর কাহিনী তো শুনলেন, এবার শুনুন বাংলা-সাহিত্যের আরেক দিকপাল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী, শারদীয়া সংখ্যার রচনা সংগ্রহ উপলক্ষ্যে।
শারদীয়া পত্রিকার জন্য লেখা চেয়ে প্রথম দফা পদ্ধতির চিঠি ছাড়ার সাত দিন পরে তারাশঙ্করবাবুর চিঠি এসে হাজির। তিনি লিখেছেন—
পরমকল্যাণবরেষু
সাগরময়, শারদীয়া সংখ্যায় লেখা দেবার জন্য তোমার আমন্ত্রণলিপি পেলাম। তোমাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল দেখাসাক্ষাৎ নাই। আগামী বুধবার নয়টার মধ্যে যদি আমার বাড়ি আসতে পার তাহলে সাক্ষাতে কথা হবে। আমার এখান থেকেই তুমি অফিসে চলে যেয়ো। তোমার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ কামনা করি। ইতি–
চিঠি পেয়েই উত্তরে জানিয়ে দিলাম বুধবার যথাসময়েই আমি তার বাড়ি উপস্থিত হচ্ছি।
আমি থাকি টালিগঞ্জে আর তারাশঙ্করবাবু তখন থাকতেন টালা নয়, বাগবাজারে আনন্দ চ্যাটার্জি লেন-এ, অমৃতবাজার পত্রিকা অফিসের সন্নিকটে। এখন সমস্যা সকাল নটার মধ্যে তার বাড়ি হাজির হতে হলে আমাকে বেরোতে হয় সকাল আটটায়। সুতরাং খেয়ে দেয়ে বেরোনোর প্রশ্নই ওঠে না।
আমার গৃহিণীকে তারাশঙ্করবাবুর চিঠিটা দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম তোমার কি মনে হয়? না খেয়েই বেরোব?
গৃহিণী বললেন–খেয়েদেয়ে বেরোনর মত কোন যুক্তি তো চিঠিতে পাচ্ছিনা। অত সকালে ভাত খেয়ে যাবেই বা কি করে।
আমি বললাম,—কেন? এই যে লিখেছেন—আমার এখান থেকেই তুমি অফিসে চলে যেয়ো—এই কথাটার মধ্যে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটা ধরতে পারছ না?
অবাক হয়ে গৃহিণী বললেন–এর মধ্যে আবার ইঙ্গিত তুমি পেলে কোথায়।
মেয়েরা গল্প-উপন্যাসের একনিষ্ঠ পাঠিকা হতে পারেন কিন্তু তারা যে আভাস-ইঙ্গিত বোঝেন না বা বুঝতে চান না এ ধারণা আমার অনেককালের এবং তা বদ্ধমূল। তাই গৃহিণীকে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ঠাট্টা করে বললাম–স্ত্রীবুদ্ধি কি শাস্ত্রে বলে সাধে। ইংরেজীতে একটা কথা আছে—টু রীড বিটুইন দি লাইনস। সে-ভাবে যদি পড়তে জানতে তাহলে তোমার চোখে ও-দুটি লাইনের মাঝে চারটি ডাল-ভাত খেয়ে কথাটা জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠত।
গৃহিণী আর কথা বাড়ালেন না। বদ্ধি নিয়ে ইঙ্গিত করলে তিনি নীরব থাকাই পছন্দ করেন।
বুধবার সকালে তাড়াহুড়ো করে স্নান সেরে বেরোতে যাচ্ছি, গৃহিণী একথালা লুচি আর বেগুনভাজা এনে বললেন–পেট ভরেই খেয়ে যাও, সাহিত্যিকদের কথায় আমার বেশি ভরসা নেই।