৩. ওই সময় থেকেই হিটলার আর্মি-অফিসারদের ঘৃণা করতে আরম্ভ করেন বললে হয়তো অত্যুক্তি তথা বিনা যুক্তিতে জটিল সমস্যাকে অত্যধিক সরল করে ফেলার ওভার সিমপ্লিফিকেশন অকর্ম করা হবে। তবে এ কথা সত্য, পরবর্তীকালে জর্মন আর্মি ছিল তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয় প্রতিষ্ঠান– except the army officers, এবং এটাও বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য যে, আত্মহত্যা করার ঠিক ২২ ঘণ্টা পূর্বে তিনি তার জীবনের যে সর্বশেষ পত্র লেখেন সেটি আর্মির সর্বপ্রধান কর্তা– অবশ্য তার পরে–কাইটেলকে। সে চিঠির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জর্মন আর্মি-অফিসারমণ্ডলীকে, আমাদের ভাষায় যেন পৈতে ছিঁড়ে, উচ্ছন্ন যাও, উচ্ছন্ন যাও বলে ব্রহ্মশাপ দেওয়া। সে পত্রে তিনি বলেন, গত (প্রথম) বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পাই, এ যুদ্ধের জর্মন অফিসারগণের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধের অফিসারদের কোনও তুলনাই হয় না। এ যুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে সংগ্রামকারী জোয়ানদের সাফল্যের তুলনায় অফিসারগণ যেটুকু সামান্য করতে পেরেছেন সেটা জোয়ানদের কর্মসিদ্ধির তুলনায় অতিশয় তুচ্ছ।
৪. হিটলারের খাস চাকর– valet– ছিলেন জনৈক হাইনৎস লিঙে। ইনি হিটলারের জামাকাপড় দুরস্ত রাখা, ঔষধ-পত্র হামেহাল হাজির রাখা, এসব শত কাজ তো করতেনই– এমনকি ইভনিং ড্রেস পরার সময় বো-টিও তিনি বেঁধে দিতেন। কিন্তু তাঁর সর্বাপেক্ষা অন্তরঙ্গ এবং গরিমাময় কর্মও বটে– জর্মনির ফুরার ও তার প্রিয়া এফার বিছানা তৈরি করা। একদা তিনি দুজনকে এমন অবস্থায় পান হিটলার ব্যত্যয়-বিহীন অভ্যাসমতো মাত্র সেই এক দিন দোরে চাবি দিতে ভুলে গিয়েছিলেন যে তার চাকরি যাবার যোগাড় হয়েছিল। এই কর্মের জন্যে তাকে বাছাই করা হিটলারের অতিশয় খাস সেনাবাহিনীর (এস এস = শুৎসৃস্টাফেল) সর্বশ্রেষ্ঠ এক হাজার সৈন্য থেকে। প্রভুকে পূর্ণ দশটি বছর সেবার পর যখন হিটলার মিত্রশক্তির নিপীড়নে বার্লিনে প্রায় অবরুদ্ধ হতে যাচ্ছেন তখন অবশ্য মৃত্যু থেকে নিষ্কৃতি দেবার জন্য হিটলার তাঁকে ডেকে আপন পরিবারে চলে যাবার অনুমতি দেন। প্রভুভক্ত লিঙে যাননি। ফলে হিটলারের শেষ পর্বের আত্মহত্যার বুলেটশব্দ পর্যন্ত তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনতে পান, তাঁর মৃতদেহ চিতাস্থলে বয়ে নিয়ে যেতে, চিতাতে অগ্নিসংযোগ করতে সাহায্য করেন। এফাও এঁকে বড়ই বিশ্বাস করতেন এবং প্রাণের কথাও খুলে বলতেন।
হিটলারের ভূগর্ভস্থ, বিরাটতম বোমার আক্রমণেও নিরাপদ বুঙ্কার তিনি প্রভুর শবদাহ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরিত্যাগ করেননি। সে কর্ম সমাধান করে তিনি যখন রুশ সেনানী ভেদ করে– রাশানরা তখন বুঙ্কার থেকে তিনশো গজ দূরে মার্কিন অধিকৃত এলাকায় আপন পরিবারের সঙ্গে মিলিত হবার চেষ্টা করেন তখন বার্লিনেই রুশদের হাতে বন্দি হন। পূর্ণ দশটি বছর তিনি ওই দেশে ডাকসাইটে সব কারাগারে– (কিছুকালের জন্য সাইবেরিয়া বাস করে তিনি বিশ্ববন্দিমণ্ডলীতে যেন সোনার তাজ পেয়েছেন!)– বহু যন্ত্রণা ভোগ করে ১৯৫৫-এ পশ্চিম বার্লিনে ফিরে আসেন। এসেই তিনি হিটলার সম্বন্ধে প্রচলিত বহুবিধ গুজব বিনাশার্থে একখানা চটিবই লেখেন। তার এক স্থলে আছে, বিদেশের কোনও হোমরা-চোমরা তার সঙ্গে দেখা করে তার পদলেহন করার পর তিনি অতিশয় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বললেন, দেখলে লিঙে, (ইনি কোনও কোনও সময় অভ্যাগতের জন্য পানাদি নিয়ে যেতেন– লেখক) ব্যাটারা কীরকম গত যুদ্ধের সামান্য এক জোয়ানের (হিটলার কর্পোরেল ছিলেন) সামনে হাঁটু নিচু করছে। আর বিদেশি কোনও জঙ্গিলাট হলে তো কথাই নেই। বস্তুত হিটলার প্রকৃত মহাপুরুষদের মতো এসব বুর্জুয়া সুবদের উপেক্ষা না করে তাদের সাষ্টাঙ্গ প্রণামে পরিতৃপ্ত হতেন– যেন তাঁর তরুণ বয়স ও যৌবনকালে আহত আত্মাভিমান সান্ত্বনাপ্রলেপ পেয়ে বেদনা-দাগটা (তখনও!) লাঘব করে দিত। লিঙে সম্বন্ধে আমি হিটলারের শেষ দশ দিন নামক প্রবন্ধে, দু হারা গ্রন্থে ঈষৎ সবিস্তারে লেখার সুযোগ পেয়েছিলুম।
৫. আসলে কিন্তু এই সখা অতিশয় সদাশয় ভদ্র নির্লোভ ব্যক্তি। ওঁদের বয়স যখন প্রায় কুড়ি (১৯১০-১১ গোছ) এবং একসঙ্গে একই কামরায় ভিয়েনায় বাস করতেন তখন হিটলার দৈন্যপঙ্কে নিমজ্জিত হতে হতে শেষটায় এমন অবস্থায় পৌঁছলেন যে, অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী সখা গুস্তাফকে বিব্রত না করার জন্যে হিটলার আমৃত্যু ছিলেন এমনই আত্মাভিমানী, touchy, যেটাকে নিশ্চয়ই morbid বলা চলে– একদিন সখাকে কিছু না বলে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে গেলেন। তার প্রায় ২৫ বছর পর হিটলার লোকচক্ষের সম্মুখে রাজনৈতিক নেতারূপে ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করেছেন, তখন গুস্তাফ খবরের কাগজ মারফত, তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানতে পারলেন। তার পর ১৯৩৩-এ যখন হিটলার চ্যান্সেলর হলেন তখন দীর্ঘ ২৩ বছর পর গুস্তাফ তাঁকে চিঠি লিখলেন। উত্তরও পেলেন। ১৯৩৪-এ হিটলার অস্ট্রিয়া দখল করে যখন বিজয়ী বীরের মতো লিৎসে পৌঁছলেন তখন দুই সখাতে দেখা হল। গুস্তাফ ছোট্ট সরকারি চাকরি করতেন এবং অল্পেই সুখী ও সন্তুষ্ট ছিলেন বলে হিটলারের big offer তিনি গ্রহণ করলেন না। তবে প্রতি বছর দু-একবার হিটলারের নিমন্ত্রণে প্রধান প্রধান সঙ্গীতের জলসা উৎসবে একসঙ্গে যেতেন। বস্তুত হিটলারের সর্বজীবনীকার একবাক্যে বলেছেন, গুস্তাফই একমাত্র হিটলার-সখা যিনি তাদের বন্ধুত্ব পৌন্ড-শিলিঙে পরিবর্তিত করেননি। জলসাতে যে যেতেন তার একমাত্র কারণ এক জলসাতেই আপন ছোট শহরে তাঁদের প্রথম পরিচয় হয়– সঙ্গীতই ছিল উভয়ের প্রাণতুল্য প্রিয়। গুস্তাফের ভদ্র আত্মবিসর্জন কতখানি, পাঠক এর থেকেই বুঝতে পারবেন যে, তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন সঙ্গীত, কিন্তু সে পথে সুযোগ না পেয়ে একটি ছোট্ট দফতরে চাকরি নেন। হিটলার তাকে বলেন, যেখানে খুশি বল, আমি সরকারি সঙ্গীতালয়ে তোমাকে প্রধান সঙ্গীতচালক করে দিচ্ছি। তুমি পাবে, সর্বসময়, সর্বাবস্থায় আমার প্রটেকশন! শুস্তাফ সে লোভও সংবরণ করেন।