হিটলার যখন স্কেচের উচ্চতম নভঃলোকে উডডীয়মান তখন কিন্তু তার সখা, জীবনী-লেখক প্রখর ব্যবসায়-বুদ্ধিধারী– তাঁর পিতাও ব্যবসায়ী– ঘোর বস্তুতান্ত্রিক গুস্তাফ–এককথায় স্বপ্নলোক নিবাসী ডন কুইকসোটের যেমন হুবহু উল্টো কড়া সংসারী তামসিক সাঙ্কো পাজা, এস্থলে হিটলারের সাঙ্কো পাজা, ভিন্ন গোত্রের বসওয়েল, স্কেচের পাশে দাঁড়িয়ে বলত, হুঃ! সবই বুঝলুম, কিন্তু সেই বস্তুটি টাকা! তিনি জানতেন হিটলারের বৃদ্ধা মাতার অতি ক্ষুদ্র পেনশন ভিন্ন সে পরিবারে একটি কানাকড়িরও আমদানি ছিল না।
হিটলার স্বপ্নভঙ্গে বিরক্ত হয়ে বলতেন, আখ তোমার শুধু টাকা, টাকা।(৫)
কিন্তু এ কাহিনী এখানেই থাক। আমি শুধু ভাবি, কবিসম্রাট দান্তের কথা।
তাঁর প্রিয়া বেয়াত্রিচে সখীজনসহ রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে শুধু একবার মাত্র প্রেম-বিহ্বল কবির দিকে স্মিতহাস্য করেছিলেন। আরেকবার পুষ্পের জন্য বিখ্যাত ফ্লরেন্স (Flora) নগরীর পুষ্পেসবে যখন সবাই সবাইকে পুষ্পেহার দিচ্ছেন, এমনকি অচেনা জনকেও তখন হয়তো কিছুমাত্র না ভেবেচিন্তেই প্রেমোন্মাদকে একটি ফুল এগিয়ে দেন। ব্যস! আর তো কিছু জানবার উপায় নেই। তাই বোধ হয়, তথ্য যেখানে যত কম, কিংবদন্তি সেখানে, সেই অনুপাতে তত বেশি। সেই শত শত কিংবদন্তির মাঝখানে একটি সত্য প্রোজ্জ্বল; দান্তের সুপ্ত কবিসত্তা তাকে সচেতন করে দিয়ে বলল, তোমার প্রেমে আর এই নগরীর শত শত প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেমে পার্থক্য কোথায়? বিনয়ভরে যেন সেই পরমাত্মার সম্মুখে মস্তক নত করে দান্তে রচনা করলেন তার স্বর্গীয় কাব্য (দভিনা কম্মেদিয়া= ডিভাইন কমেডি)।
দান্তে আপন জন্মের নগর থেকে বিতাড়িত হন– রাজনীতির জুয়াখেলাতে হেরে গিয়ে। হিটলার স্বেচ্ছায় (বা অনিচ্ছায়) স্বদেশ অস্ট্রিয়া ত্যাগ করে জনি গিয়ে সেখানে পূর্ণ বারোটি বছর রাজমুকুট পরার পর নিজ হাতে আপন প্রাণ নিলেন। আমি শুধু ভাবি হিটলার যদি রাজনীতিতে দান্তের মতো নিষ্ফল হতেন তবে হয়তো তিনিও তার বেয়াত্রিচেকে কাব্যলক্ষ্মীর স্বর্ণমন্দিরে অজরামর করে রেখে যেতেন, অবশ্য হিটলার নিশ্চয়ই দান্তের ইফেরননা (নরক) অধ্যায়টা লিখতেন বেশি ফলাও করে। কিংবা হয়তো কাব্যলক্ষ্মীর নবীন মন্দির নির্মাণ করে– স্থাপত্যেই হিটলারের সর্বাধিক প্রতিভা ছিল, এ সত্য তাঁর শক্ৰমিত্র সবাই স্বীকার করেন।
———–
১. আমার আশ্চর্য বোধ হয় এইসব ডিপ্লোমেটরা সেই নরঘাতক হিটলারের সম্মুখে তখন কী বেহদ বেহায়া, বেশরম, বেইজ্জৎ বাঁদর-নাচ, আবার বলছি, কোমরে ছিটের ঘাগরা পরে বাঁদর-নাচ নেচেছেন! পরে এঁদের অনেকেই বলেছেন– শিশুর মতো গদ্গদ সরল কন্ঠে আমরা তখন জানতুম না, মাইরি, লোকটা ও-রকম একটা আস্ত নর-পিশাচ। বটে! ন্যাকামির জায়গা পাওনি? তোমরা Fool তো বটেই তদুপরি knave! তোমরা বুকে হাত দিয়ে বল, তোমরা জানতে না, হিটলার রাজাসনে বসার প্রথম দিনই কম্যুনিস্টদের ওপর কী অকথ্য অত্যাচার আরম্ভ করে, তার পর ইহুদিদের নিয়ে, তার পর ২০ জুলাই ১৯৩৪-এ তাঁর সহকর্মীদের রোম্ এর্নস্ট, হাইস (আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস এরা ছিল নির্দোষী)- mass murder, without any trial (শব্দার্থে নির-বিচারে পাইকারি হারে খুন) তোমরা তো তখন নিতম্ব বাজিয়ে নৃত্য করেছ! কণ্টক কণ্টকে নাশ! মুখে যতই ধানাইপানাই কর, ইহুদিদের প্রতি তোমাদের মনোভাব অন্তত আমার অজানা নয়। আর যদি এ-সব না জানতে তবে নিজেদের ডিপ্লোমেট বলে পরিচয় দাও কেন? রাস্তার মেথরানি আর তোমাতে তা হলে কী তফাত!
২. এরা যখন মার্কিন জেল থেকে মুক্তিলাভ করল, ততদিনে আবার জর্মনিতে আপন আধা-স্বাধীন সরকার, মায় আদালতসুদ্ধ বসে গেছে। এই আদালত এদের এবং অন্য বহু লোককে ধরে আবার আরম্ভ করলে denazification (অর্থাৎ দেশকে ভূতপূর্ব নাৎসিমুক্ত করা) মোকদ্দমা গণ্ডায়-গণ্ডায়। এনারা আবার ওয়াদের চেয়ে এককাঠি সরেস। কারণ জজদের অনেকেরই সামনে এসে দাঁড়ালেন এমন সব নাৎসি যাদের হাতে বিচারকরা নাৎসি-রাজত্বে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। (অবশ্য লাঞ্ছিত হওয়ার সময় তাঁরা জজ ছিলেন না, কিংবা ডিসমিস হয়েছিলেন) এঁরা নিলেন তাদের পূর্ণ প্রতিহিংসা– জেল, নাগরিকাধিকার লোপ এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হল বহু লোকের এমনকি যাদের মার্কিন কোর্ট কোনও প্রমাণ না পেয়ে বেকসুর ছেড়ে দিয়েছিল। আবার উল্টোটাও হল। যেখানে জজ নির্বাচিত হলেন কোনো প্রচ্ছন্ন নাৎসি তখন তিনি পাঁড় নাৎসিদের অনেককেও ছেড়ে দিলেন কিংবা দিলেন মোলায়েমতম সাজা। তার পর হল আরেক ফার্স। জর্মন আইনে নিয়ম (এ আইন রোমান আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ আইন তা নয়) কোনও অপরাধের বিশ বছর পরে সন্দেহযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনও মোকদ্দমা হতে পারে না। হিটলার আত্মহত্যা করেন ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫। মোটামুটি বলা যেতে পারে হিটলার নির্বাচিত নবীন চ্যান্সেলর মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন ৮ মে। অতএব লেগে গেল ধুন্ধুমার। তা হলে ৮/৫/৬৫ তারিখে দেশে-বিদেশে লুক্কায়িত খুনিয়া খুনিয়া সব নাৎসি অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে আবার নবীন নাৎসি সঙ্ তৈরি করবার চেষ্টা করবে। হয়তো-বা এই কুড়ি বছরে যারা নাৎসিদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত কড়াকড়ি ব্যবস্থা করেছিল তারা প্রাণ দেবে গুপ্ত নাৎসি ঘাতকের হাতে, অন্ততপক্ষে গোপনে অপমানিত লাঞ্ছিত এবং প্রহৃত হবে। কারণ এদের অনেকেই ছিলেন পয়লা নম্বরি নাৎসি, যেমন হিটলারের সেক্রেটারি মার্কিন বরমান, এবং ইহুদি নিধনের গ্যাসঘর তথা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের চোপদার (ন-টি ল্যাজওলা চাবুক মারনেওলা), কমান্ডান্ট, কয়েদিদের ওপর মারাত্মক (এদের ৯৫% মারা যায়) সব ব্যারামের experiment করনেওলা ডাক্তার, অথবা পাঁড় নাৎসি সম্পূর্ণ বিবেকহীন, আইন বাবদে পরিপূর্ণ অজ্ঞ নাৎসি কর্তাদের মেহেরবানিতে নিযুক্ত জজ যারা কারও বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ (নাসি) মোকদ্দমা আনা মাত্র আসামিকে অপমানিত লাঞ্ছিত করে– মুক্ত অথবা গুপ্ত আদালতে হয় ফাঁসির হুকুম, নইলে চৌদ্দ বছরের জেল। এদের অনেকেই-বা অজ্ঞাতবাস থেকেই বেনামিতে নাৎসিবৈরীদের শাসিয়েছে। তাই বহু আন্দোলনের পর এমনকি ক্যাবিনেটে এ-বাবদে দ্বিধা ছিল– যে, যদ্যপি ৮/৫/৪৫-এর পর কোনও নাৎসিরাজ ছিল না, এবং ফলে তার পর কোনও নাৎসি অপরাধ হয়নি এবং বিশ বছর পর সব খতম হওয়ার কথা। তবু আরও দশ না কুড়ি বছর ধরে (আমার ঠিক মনে নেই) পূর্ব-নাসরা ধরা পড়লে মোকদ্দমা চলবে।