এবং বিশ্বের ইতিহাসে এই অতুলনীয় ধর্ম প্রচারক বক্তা, জনগণমনজয়ের বীর গ্যোবেলস প্রায় প্রতিবারই তাঁর ভাষণ শেষ করতেন এই বলে, বিশ্বের ইতিহাসের এই সর্বোত্তম আত্মত্যাগ বিশ্ববিধাতা কর্তৃক লাঞ্ছিত হবে না। (কানে কানে বলি গ্যোবেলস ছিলেন নিরঙ্কুশ নাস্তিক; বরঞ্চ তার প্রভু হিটলার অন্তত অদৃশ্য অজ্ঞেয় অন্ধ নিয়তিতে– শিঞ্জাল–বিশ্বাস করতেন)।
আজ হিটলার চিতাশয্যায় (বস্তৃত তাঁর ও পত্নী এফার দেহ তাঁরই সর্বশেষ আদেশানুসারে দেশাচারানুযায়ী গোর না দিয়ে পেট্রল দিয়ে পোড়ানো হয়) প্রবেশকালের প্রাক্কালে বিবাহ করলেন তার রক্ষিতাকে– যার সঙ্গে তিনি লোকচক্ষুর অগোচরে সর্ববিলাসবৈভবে পরিপূর্ণ সুসজ্জিত শৈলাবাসে কাটিয়েছেন কত-না ক্লান্তিহীন দিবস, নিদ্রাহীন রভস যামিনী, বছরের পর বছর, অন্তত চৌদ্দটি বছর অর্থাৎ দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করার প্রায় দু-বছর আগে থেকে!
কই, গ্যোবেলসের অঙ্কিত সেই বিলাসবিমুখ জিতেন্দ্রিয় সর্বত্যাগী রাইষের মঙ্গলকামনায় ধ্যানমগ্ন তপস্বীর সঙ্গে তো বেতারে প্রচারিত, একগুণকে শতগুণে বর্ধিত করে বিজয়ী মার্কিন সেনা উপস্থিত তারা জর্মনিতে থানা গেড়ে তার উপর সার্বভৌম রাজত্ব করছে এবং তাদের অভ্যালার্জিত কেলেঙ্কারি কেচ্ছা বর্ণনের সুমেরু শিখরে তথাগত তথাকথিত জার্নালিস্টের প্রকাশিত জর্মন এবং ইংরেজি ভাষাতে প্রচারিত দৈনিক, সাপ্তাহিকে প্রকাশিত হিটলারের ছবি আদৌ মিলছে না।
বেৰ্ষটেশগাডেনে হিটলারের শৈলাবাস ছিল দশাধিক বছর ধরে সর্ব ধার্মিক নাৎসি, এমনকি মধ্যপন্থী সরলহৃদয় লক্ষ লক্ষ জর্মনেরও পুণ্যতীর্থভূমি। হিটলার সচরাচর থাকতেন নীরস বিরস বৈশ্যভূমি বার্লিনে; সম্মুখে কৃষ্ণকঠিন প্রস্তর-নির্মিত অপ্রিয়দর্শন বস্তুতান্ত্রিক রাজবর্ত্ম, চতুর্দিকে অভেদ্য পাষাণ প্রাচীর, পাষাণতর হৃদয়নির্মিত, বদনমণ্ডলে সর্বপ্রকারের অনুভূতি প্রকাশবর্জিত, শীতল কৃষ্ণধাতুতে নির্মিত অস্ত্রহস্তে রক্ষীদল, পাত্র-অমাত্যের স্বতশ্চল শকটের যন্ত্রীরব-বিষোষ নিনাদ, সদাই ফুরারের পরিদর্শনের জন্যে বিকটতম শব্দ করে দ্রুতগতিতে গমনাগমনরত দৈত্যসম পর্বতপ্রমাণ ট্যাঙ্ক-বর্ম পরিহিত সাঁজোয়া যান, আরও কত না নবীন নবীন বৃহৎ বৃহৎ মারণাস্ত্র, এবং ফুরার ভবনের প্রশস্ত মর্মর সোপান বেয়ে উঠছেন নামছেন অভিজাত শ্রেষ্ঠদের মুকুটমণি রাজদূতরাজি– তাদের বেশভূষার দিকে তাকালে অন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কা। বেশের উত্তমার্ধ স্বর্ণাস্তরণে এমনই অলঙ্কৃত— যে তার পটভূমি চীনাংশুক, পট্টবস্ত্র, না কিংখাপে নির্মিত সে তত্ত্ব নির্ণয় করা অসম্ভব। প্রত্যেকেরই সেই স্বর্ণাস্তরণের উপর হীরকখচিত ভিন্ন ভিন্ন মহার্ঘ্য ধাতুনির্মিত সারি সারি মেডেল বিজয়-লাঞ্ছন– মনে হয় তার যে কোনও একটা সারির উপর দিয়ে দ্রুতগতিতে একটিবার আঙুল চালিয়ে নেওয়া মাত্রই বেজে উঠবে যেন জলতরঙ্গে স্বরসপ্তক।
মানুষের ভক্তি যতই গভীর হোক, সেটা অতল নয়- গভীরতম মহাসমুদ্রের তল আছে। যতই গগনচুম্বী হোক গৌরীশঙ্কর নয় এবং তিনিও চুম্বন করেন মহাউর্ধ্বের পদরেণুকণা অভ্রংরাশিমাত্র। কাজেই সেই ভক্তি বার্লিনের ওই মারণাস্ত্র যক্ষপুরীকে পুণ্যতীর্থ ভূমিতে পরিণত করতে পারেনি।
তারা ছুটে আসত বেৰ্ষটেশগাডেনে। তার পরিবেশ, তার বাতাবরণ, তার চতুর্দিকে দীর্ঘশির অভিজাত শ্যামল বনস্পতি, উচ্চতায় সেইসব বনবৃক্ষের তুলনায় সহস্রগুণে উচ্চ পর্বত, মেখলাকার শৈলমালা, তাদের অনেকেই শীতে-গ্রীষ্মে তুষারাবৃত, আর শীতকালে হিটলার ভবনের চতুর্দিকে হয়ে যায় ধবল বরফাচ্ছন্ন। গ্রীষ্মের দীর্ঘ দিনে বনস্পতিরাজি নিরবচ্ছিন্ন বন্য বিহঙ্গসঙ্গীতে পরিপূর্ণ।
লক্ষ লক্ষ নরনারী শোভাযাত্রা করে লাইন বেঁধে হিটলারের সামনে দিয়ে গৃহীর সরলতামাখা –অর্থাৎ কর্কশ মিলিটারি কেতায় নয়–মার্চ পাস করত– হিটলার বিদেশাগত লয়েড জর্জ, জন স্যামুয়েল, অ্যান্টনি ইডেন জাতীয় অভ্যাগতদের আপ্যায়নে বা চপেটাঘাত প্রদানে অত্যধিক তৎপর না থাকলে পর।(১) নইলে এমনিতে দৈনন্দিন গেরস্তালি জীবনে হিটলার ছিলেন আদর্শ অতিথিসেবক, এবং এসব অপরিচিত লক্ষ লক্ষ অতি সাধারণ তীর্থযাত্রীদের প্রতি মাত্রাধিক সদয়। হিটলারের সেই বাড়ি নতুন জমিতে গড়া হয়েছিল বলে তখনও ছায়া দেবার মতো বিস্তৃত ও দীর্ঘ বৃহৎ বৃক্ষ একটিও ছিল না। সেই কঠোর রৌদ্রে (উঁচু পাহাড়ের উপর রোদ বড় কড়া হয়। কখনও কখনও তিনি পুরোপাক্কা দু ঘন্টা ধরে হিটলারি হাইল সেলুটে ডান হাত সম্মুখ দিকে প্রসারিত করে স্কন্ধাবধি উত্তোলিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতেন– পুরো প্রসেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত। একদিন তার সখা ওস্তাদ ফটোগ্রাফার হফমান (এঁর নামটি মনে রাখবেন, পাঠক, ইনি হিটলারের প্রেমমঞ্চে বিদূষক–বিশুদ্ধ সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রানুযায়ী তিন অঙ্ক নাটিকার শেষে দুই অঙ্কে এবং সেই দুই অঙ্কে অভিনেতা মাত্র তিনজন– নায়ক, নায়িকা ও বিদূষক হফমান) হিটলারকে শুধোন, তিনি কী করে পুরো দু ঘন্টা ধরে, এরকম হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন। হিটলার উত্তরে বলেন, নিছক মনের জোরে।
দ্বিতীয় শকের পর এইসব লক্ষ লক্ষ তীর্থ-প্রত্যাবর্ত ও ভগবান হিটলারের শ্রীমুখ দর্শনপ্রাপ্ত নরনারী বিহ্বল, সামান্য দুটি অসংলগ্ন বাক্য সংযোজিত করতে সম্পূর্ণ। অক্ষম, কর্তাভজাদের ন্যায় শুরু কাণ্ডারিতে যারা সর্ব প্রত্যয় সর্ব আত্মোৎসর্গ করে আপন আপন নোঙর ভবনদীতে অবহেলায় বিসর্জন দিয়ে বসেছিল, তারা তখন কী ভেবেছিল?