ইংরেজি তো এদেশে একশো বছর ধরে কমপালসারি ছিল। ইংরেজি শিখলে আর্থিক সামাজিক উন্নতি হবে বলেই লোকে ইংরেজি শিখেছে। জ্ঞানার্জন করে চিত্তপ্রসারের জন্য ইংরেজি শিখেছে একথা বললেও আমি বিশ্বাস করব না। এখন বলুন কটা লোক অবসর সময় ইংরেজি বই পড়ে, ইংরেজি বই কেনে? এ তো সাধারণ জনের কথা, কিন্তু প্রত্যয় যাবেন না, আমার পরিচিত একটি ছোকরা ইংরেজির লেকচারার সর্বক্ষণ বাঙলা বাঙলা করছে, রবীন্দ্রসাহিত্যে তার সুন্দর দখল, কৌতূহল প্রশংসনীয়। ওদিকে ইংরেজির বেলা সেখানে পড়াশুনো করে আরও চৌকশ হবার কোনও চাড় নেই। জানে যেটুকু ইংরেজি রপ্ত আছে সেইটে ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে সে একদিন রিডার ও যথারীতি প্রফেসরও হবে।
এই সেমি-কমপালসরি সংস্কৃত, ফারসি, আরবি (বা পালি লাতিন) নিন। সায়েনসে সিট পায়নি বলে, বা অন্য যে কোনও কারণেই হোক, প্রায় অনিচ্ছায় বিএ পাসের সময় সংস্কৃত ছিল। হয়তো-বা অনার্সও ছিল। তাদেরও কজনকে আপনি অবসর সময় সংস্কৃত (বা ফারসি) পড়তে দেখেছেন, তার শেলফে নতুন কেনা সংস্কৃত বই দেখেছেন? ফারসি তো অতি সরল ভাষা– কজন ফারসি অনার্সওলা গ্রাজুয়েট ফারসি আউট-বুক পড়ে?
অবশ্য যারা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় দুই বা তিনটি ভাষা শেখেন– বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, তাঁদের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। অধ্যাপক সত্যেন বোস স্বেচ্ছায় ফরাসি-জরমন শিখেছেন। এখনও ওই দুই ভাষায় বই পড়েন।
***
অগুনতি দফে প্রশ্ন শুনতে হয়েছে, ইংরেজিতেই চলবে তো? অন্য কোনও ভাষা না জানলেও চলবে–না? কনটিনেনটে তো সবাই ইংরেজি বোঝে না?
হু, বোঝে। খুব বোঝে! তবে শুনুন। গল্পটি অবশ্য প্যারিস সংক্রান্ত নয়– যদিও খুদ প্যারিসেরই কোনও একটা মুদির দোকানে তেল-নুন কেনার চেষ্টা করে দেখুন না ইংরেজির মারফত তবে এটি পৃথিবীর যে কোনও জায়গা সম্বন্ধে প্রযোজ্য, সেটা পৃথিবী প্রদক্ষিণ না করেও বলা যায়।
প্রভাঁসের একটি দোকানের সামনে বেশ মোটা মোটা হরফে লেখা : ENGLISH SPOKEN। এটার উদ্দেশ্য মারকিন টুরিস্টকে আকর্ষণ করা। ইংরেজকে নয়। কারণ ফরাসি জাত বিস্তর মার খেয়ে খেয়ে ভালো করেই জানে, ইংরেজ কিপটেমিতে প্রায় তাকেও হার মানায় এবং জাতটার আগাপাশতলা বেনেদের হাড্ডি দিয়ে তৈরি বলে দোকানের প্রত্যেকটি জিনিসের পাইকিরি ভাও, খুচরো দর, কমিশন, সেল ট্যাক্স দফে দফে জানে। তা সেকথা থাক গে … এস্থলে ঢুকেছে এক মারকিন। খাজা মারকিন ড্রল (আড়) সমেত একাধিকবার মারকিনি জবানে বলে গেল তার প্রয়োজন অথচ কাউন্টারের পিছনে ফরাসি দোকানউলি শুধু মিটমিটিয়ে মৌরি হাসি চিবোয়–মাল কাড়বার কোনও নিশানাই নেই। মারকিন বার বার একই কথা বলতে বলতে হঠাৎ বুঝতে পারল, মাদাম তার কথা এক বর্ণও বুঝতে পারছে না। বিরক্ত হয়ে তখন সে সেই সাইনবোর্ড-টার দিকে আঙুল তুলে বলল, তবে ওটা ওখানে ঝুলিয়েছ কী করতে? ইংরেজি যখন বোঝে না এক বর্ণও? এবারে যেন মাদাম ব্যাপারটা বুঝেছে নিশ্চয়ই এ ফারুস্ আকছারই হয়– একগাল হেসে তার ইংরেজিভাষা ভাণ্ডারের শেষ শব্দটি খরচা করে বলল, উই, উই, ইয়েস ইয়েস, এঙলিশ স্পোকেন! সারতেনলি। আওয়ার কসতোমারস স্পিক–উই নত স্পিক— হ্যাঁ, যা, ইংরেজি বলা হয় বইকি! আমাদের খদ্দেররা বলেন। আমরা বলি না।
এটি মনে রাখবেন। আপনার অন্য কোনও কাজে না লাগলেও এটি দিয়ে ব্যাকরণের প্যাসিভ ভইস এবং তস্য প্রসাদাৎ কী কী সুখ-সুবিধে হয় সেটা বাচ্চাদের শেখাতে পারবেন। মাদাম তো আর নোটিশে বলেনি, উই স্পিক ইংলিশ, বলেছে ইংলিশ স্পোকেন এবং ইহসংসারে কে কোথায় ইংরেজি বলে কি না বলে, সেটা কুইনজ ইংলিশ না সাউথ ক্যারোলাইনার নিগার ইংলিশ সে খতিয়ান দেবার জিম্মেদারি তো বেচারি প্রভাসিনী দোকানউলির নয়!
খোদ প্যারিসের মুদির কথা বলছিলুম। আপনি হয়তো বিরক্ত হয়ে বলবেন, তুমিও য্যামন! আমি কি প্যারিস যাচ্ছি ঘৃতলবণতৈলতণ্ডুলের জন্য! এস্থলে আমাকে একটু কথা কাটতে হল। বলতে কী, আমার মনে হয়, এইসব বস্তু আপনি যদি প্যারিসে কিনে এদেশে চালান দিতে পারেন– অবশ্য অম্মদেশীয় সদাশয় সরকার যদি তার ওপর বেদরদ ট্যাকশো না চাপান তবে আপনার প্যারিস ভ্রমণের খরচটাই উঠে যাবে। আর ইতালির ব্রিদিসি, বারি অঞ্চলে চালের কিলো নিশ্চয়ই আড়াই/ তিন টাকা নয়! সর্বোপরি অলিভ তেল! লাল হয়ে যাবেন, মোয়াই, লাল হয়ে যাবেন। ফ্রান্সের মার্সেই অঞ্চলের পাঁচসিকের তেল হেলায়–কালোবাজারে নিদেন পঞ্চবিংশতি তঙ্কা! তা সে যা গে! ইংরেজের সঙ্গে দুশো বছর ঘর করে আমি– সৈয়দের ব্যাটা–আমিও বেনে বনে গিয়েছি– প্যারিস পৌঁছে কোথায় না সন্ধান নেবো উবিগা কোতির ভুরভুরে খুশবাই তা না, ত্যালের কেলো, চেলের ভাও! লাও!
প্যারিসের প্যারিসের কেন– পৃথিবীর পয়লা নম্বরি সর্ব হোটেলের ওয়েটার, রুমবয়, কাউন্টারের কেরানি এরা সবাই অল্প-বিস্তর ইংরেজি বলতে পারে। কিন্তু আপনি সেসব হোটেলে উঠবেন না– গ্যাটে আপনার অত রেস্তো নেই, থাকলে আমার লেখা পড়তেন না। আর যদি বলেন, না, আপনার সে রেস্তো আছে, তা হলে আর ভাবনা কী? আপনি কোন দুঃখে প্যারিস বালিনে কে কতখানি ইংরেজি বোঝে না বোঝে তাই নিয়ে মাথা ঘামাবেন? রেখে দিন হাজার দুই-আড়াইয়ের মাইনের একজন প্রাইভেট সেক্রেটারি– সে নিদেন আধা ডজন কটিনেন্টাল ভাষা ঝাড়তে পারে, আপনাকে আর দেখতে হবে না। স্বপ্নেই যখন খাচ্ছেন তখন পোলাই খান, ভাত খাচ্ছেন কেন, আর সে পোলাওয়ে ঘি ঢালতেই-বা কসি কচ্ছেন কেন? বরদার মহারাজাকে দিনের পর দিন অনায়াসে মিশরে চলাফেরা করতে দেখেছি। কবীন্দ্র রবীন্দ্র যখন প্রাগ বা বুডপেশটে বক্তৃতা দিতেন তখন সেখানকার য়ুনিভারসিটির সবচেয়ে সেরা ইংরেজিবাগীশ অধ্যাপক হতেন তার দোভাষী। এদের কথা আলাদা। আপনি যদি সে পর্যায়ে হন তবে আমার লেখা পড়ছেন কোন বদকিসমতের গেরোতে?