কিন্তু স্ট্রাইপট ট্রাউজারজ তো আর বাঘের দুধ নয়, বাঘিনীর দুধও নয়। আপাতক সে বস্তু মেলে কোথা? ওদিকে প্লেনারি কনফারেন্সের সময় যে ঘনিয়ে আসছে। হে ভগবান! প্রতি মুহূর্তের এ কী গব্বযন্ত্রণা!
***
এমন সময় করিডরে শতকণ্ঠে বাইশটে ভাষায় চিৎকার হই-হুল্লোড়।
পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে! কোথায়? কোথায়?
যে মেয়েটি ভ্যালে, চাকরবাকরদের কুটুরিগুলোতে তাদের বিছানাপত্র ঝেড়ে-কুড়ে দেয়, সে কার্জনের ভ্যালের তোশক ঝাড়তে গিয়ে দেখে তার নিচে পরিপাটিরূপে টান-টান করে সাজানো চার জোড়া স্ট্রাইপট পাতলুন। আমরা, গরিব দুঃখীরা যাদের বাধ্য হয়ে মাঝেমধ্যে স্যুট পরতে হয়, তারা জানি, পাতলুনের ক্রিজ দুরস্ত করার জন্য এর চেয়ে মহত্তর মুষ্টিযোগ নেই।
কিন্তু সর্বজ্ঞ কার্জনের সেদিন নবীন জ্ঞানসঞ্চয় হল ॥(২)
———–
১. কার্জন-ইসমেতের দ্বন্দ্বযুদ্ধে ইসমেতের শেষ পর্যন্ত নিরঙ্কুশ জয় হলে পর সাংবাদিকরা তাকে অভিনন্দন জানাতে আসেন। অতিশয় সবিনয়ে তিনি নিবেদন করেন, না, না, আমার আর কী কীর্তি! আমি কালা– আল্লাকে অসংখ্য শোকরিয়া ধন্যবাদ।
২. কাহিনীটি যিনি আমাকে সর্বপ্রথম বলেন তার মতে লিটন স্ট্রেচিই নাকি ইটি সকলের পয়লা লিপিবদ্ধ করেন। আমি ভিন্ন ভিন্ন কীর্তন শুনেছি।
হিটলারের প্রেম
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১ মে জর্মনির জনসাধারণ পেল তার মোক্ষমতম শক্– যেন দেশবাসী আবালবৃদ্ধবনিতার মস্তকে স্বয়ং মুষ্টিযোদ্ধা ক্লে একখানি সরেসতম ঘুষি মেরে তাদের সবাইকে টলটলায়মান পড়পড়ায়মান করে দিলেন। ঘুষিটা এল হামবুর্গ বেতারকেন্দ্র থেকে ইতোমধ্যে মিত্রশক্তি আকাশ থেকে জর্মনির বৃহৎ বেতারকেন্দ্রগুলো, বিশেষ করে শর্টওয়েভের প্রায় সবগুলোকেই খতম করে দিয়েছেন।
বেতারে তখন সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হচ্ছিল। সেই অনুষ্ঠান ক্ষণতরে বন্ধ করে বলা হল, আপনারা একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্য তৈরি থাকুন; কিছুক্ষণ পরেই বেতারে ঘোষিত হল, আমাদের ফ্যুরার আডলফ্ হিটলার ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
এর পর যে শকটা পেল সেটা তাদের খুলি ভেঙে দিল না বটে, কিন্তু মাথার মগজ দিল ঘুলিয়ে। যেন ওমলেট বানাবার কল ব্রেনবক্সটার মধ্যিখানে তুর্কিনাচন লাগিয়ে দিল।
হিটলার মৃত্যুর চল্লিশ ঘণ্টা পূর্বে শ্রীমতী এফা ব্রাউন নাম্নী- তাবৎ জর্মনদের কাছে অজানা-অচেনা এক কুমারীকে বিয়ে করেছিলেন। সমস্ত জৰ্মনি যেন বুদ্ধিভ্রষ্ট-জনের মতো একে অন্যকে শুধাল, সে কী! গত বারোটি বছর ধরে যে ফুরারের ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল, সে তো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর ছবি। যিনি সুখময় নীড় নির্মাণ করেননি, বল্লভার সন্ধান করেননি, এমনকি বংশরক্ষা করে উত্তরাধিকারীরূপে কাউকে স্বহস্তনির্মিত ফ্রেডারিক দ্য গ্রেটের সিংহাসন বিনিন্দিত সহস্ৰায়ু রাইষের (নাৎসি রাজ্যের) সিংহাসনে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে চাননি। অথচ তিনি কী ভালোই-না বাসতেন শিশুদের যখনই জনসাধারণের সঙ্গে মিশবার সুযোগ পেয়েছেন, তখনই দেখেছি তিনি কী হাসিমুখে শিশুদের আদর করে বাহুতে তুলে নিয়েছেন, তাদের মাতাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন, দেশের শ্রেষ্ঠা নর্তকী, অভিনেত্রী, নায়িকা, সুন্দরীদের জন্মদিনে তাঁদের বাড়িতে দেশি-বিদেশি বিরল ফুলের স্তবক পাঠিয়েছেন। প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী গ্যোবেলস আমাদের বেতারে কতশত বার বলেছেন, এই সন্ন্যাসীর হৃদয়কন্দরে কিন্তু নিভতে বিরাজ করেন সৌন্দর্যের দেবতা। এ তপস্বী সেই বিশ্বকল্পনাময়ী চিন্ময়ীর উপাসক। সে চায়, নিভৃতে নির্জনে একাগ্র মনে তাকেই রঙে রেখায় ফুটিয়ে তুলতে, তোমাদের গৃহ সুন্দরতররূপে নির্মাণ করে তারই প্রতিষ্ঠা করে তোমাদেরই গৃহ মধুময় করে তুলতে। কিন্তু হায়, তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হল। জর্মনির ভাগ্যবিধাতা তার স্কন্ধে তুলে দিলেন বিরাট বিশাল রাইষের শুরুভার। তাকে বিরাটতর, বিশালতর এবং সর্বোপরি তাকে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাষ্ট্ররূপে নির্মাণ করার গুরুভার। এবং সে রাষ্ট্র এমনই প্রাণবন্ত, দীর্ঘজীবী হবে যে, এ যাবৎ পৃথিবীতে যে সকল সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র আপন নাম ইতিহাসে রেখে গেছে তাদের সবারই হতে হবে, আমাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের তুলনায় বালখিল্যবৎ– এ রাষ্ট্রের পরমায়ু হবে সহস্র বছর– থাউজেন্ড-ইয়ার-রাইষ।
আরও অনেক কথা বলেছেন ফুরার সম্বন্ধে, অনেক ছবি এঁকেছেন অ্যাডল হিটলারের তিনি, একের পর এক বিজয়মুকুট পরে ফুরার যখন মস্কোর দ্বারপ্রান্তে যেন রাশার মৃত্যুদূত এসেছে তার আত্মাকে শয়তানের অতল গভীরে চিরতরে বিলীন করে দিতে– তাঁর সে বিজয়-গর্বিত ছবি; এবং তার পর যখন পরাজয়ের পর পরাজয় দ্রুততর গতিতে চারিদিক থেকে বজ্রমুষ্টিতে তাকে ধরতে গেছে তখনও চির আশাবাদী গ্যোবেলস তাঁর বীণাযন্ত্র ভেঙে ফেলেননি, উচ্চতর কণ্ঠে গেয়ে উঠেছেন তার প্রভু, তার ফুরারের প্রশস্তি-সঙ্গীত। যেখানে ফুরার কৃসাধনরত যযাগী। তিনি সর্বসুখ বিসর্জন করে, সর্বধ্যান নিয়োজিত করে নির্মাণ করছেন সেই ব্রহ্মাস্ত্র (প্রায় শব্দার্থ, প্রথমা বিজয়িনী Victory one, অনুজা বিজয়িনী VII)–এবারে দধীচির অস্থি নিষ্প্রয়োজন (অর্থাৎ অন্য কোনও মিত্রশক্তির সাহায্যে জয়লাভ নয়, কারণ ইতোমধ্যে তার মিত্র ইতালি ও জাপান তাদের অপেক্ষাকৃত সীমাবদ্ধ রণাঙ্গনেও কোনও বিজয়চিহ্নের আভাস দেখতে পাচ্ছে না)। তিনি এই বার্লিন নগরী ত্যাগ করবেন না। এই ধ্যানপীঠের সম্মুখে এসেই শক্রসঙ্ হবে অবলুপ্ত, লীন হবে মহাশূন্যে!