সন্ধেবেলা এরা সবাই একটুখানি আমোদ-আহ্লাদ করে নিতেন। আজ এখানে ডিনার, কাল সেখানে ডান্স, পরশু জিনিভা হ্রদে নৈশভ্রমণ।
এক সন্ধ্যায় কার্জনের ভ্যালে তাঁকে যথারীতি অত্যুত্তম ডিনার স্যুট পরিয়ে দিয়ে, সাদা বো-টি নিখুঁত বেঁধে দিলে পর সদাশয় লর্ড বললেন, আজ আর তুমি আমার জন্য জেগে থেক না; ফিরতে অনেক রাত হবে। আমি কোনওরকমে ম্যানেজ করে নেবোখন। এ যে কত বিরাট সদাশয়তা সেটা সাধারণ পাঠক বুঝতে পারবেন না। এসব লর্ডরা ভ্যালের সাহায্য বিনা জামা-কাপড় পরতে তো পারেনই না– আর বো বাধার বেলা তো ৯৯% স্রেফ ঘায়েল ছাড়তে পর্যন্ত পারেন না।
ভ্যালেটি ছিল কার্জনের চেয়েও খানদানি অবশ্য তার আপন ভ্যালে সম্প্রদায়ে। বো বাঁধাতে তার ছিল বিশ্বরেকর্ড। ১১ সেকেন্ডে সে যা বো বাঁধত, মনে হত, একদম মেশিনে তৈরি, রেডিমেড বো। অন্য লোক এস্থলে সে সন্দেহ এড়াবার জন্য বো-টি একটু ট্যারা করে নেয়। খানদানি কার্জনের বেলা অবশ্য এ সন্দেহ করতে যাবে কে?– বহু বছর পরে হিটলারের ভ্যালে লিঙে এর কাছাকাছি অর্থাৎ ১২ সেকেন্ডে আসতে পেরেছিলেন। লিঙে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, হিটলার প্রতিবার চোখ বন্ধ করে এক, দুই গুনতেন এবং লিঙের বো বাঁধা হলে সোল্লাসে বলতেন, লিঙে, এবারও কেল্লা ফতে করেছ মাত্র বারো সেকেন্ড!… উপস্থিত এ বো অনুচ্ছেদ থাক।
কার্জন তো গেলেন ব্যানকুয়েটে wined and dined হতে– সঙ্গে ত্রোন দ্য দামা বা দিমিশকের ময়ূর সিংহাসন বগলে করে নিয়ে গিয়েছিলেন কি না সে সম্বন্ধে ইংরেজি এসাইপিডিয়া, ফরাসি লিত্রে, জর্মন ব্রকহাউস– চরম পরিতাপের বিষয়– সবাই নীরব। বিবেচনা করি নিমন্ত্রণ-কর্তাই সেটি সাপ্লাই করেছিলেন। কিন্তু সে রাত্রে কিসে যেন কী হয়ে গেল, কার্জন অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন এবং রাত দশটা-এগারোটার মধ্যে হোটেলে ফিরে এলেন।
হোটেলে ঢুকতেই দেখেন বিরাট হল জুড়ে লেগেছে ধুন্ধুমার নৃত্য– সে রাত্রে সে হোটেলে ছিল গ্যালা ড্যান্স। তারই একপাশ দিয়ে পেরিয়ে গিয়ে তাকে উঠতে হবে লিফুটে। যেতে যেতে হঠাৎ তিনি থমকে দাঁড়ালেন– কে ওই লোকটি? বড্ডই যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। উৎকৃষ্টতম স্টাইলের নিখুঁত ফুল ডিনার-ড্রেস পরে সাতিশয় সুরুচিসম্মত পদ্ধতিতে নাচছে একটি সম্ভ্রান্তবংশীয়া যুবতীর সঙ্গে।
সর্বনাশ! ও গড!! এ যে তারই ভ্যালে!! নাচছে তারই ইভনিং ড্রেস পরে।
আহা, সদয় সহৃদয় পাঠক, তুমিও আমার সঙ্গে সবেদন কণ্ঠ যোগ দিয়ে বলবে, আহা, বেচারি ভেবেছিল কত্তার ফিরতে যখন দেরি হবে তখন সে-ই বা দু চক্কর নেচে নেয় না কেন?
কিন্তু এ যে ডবল মহাপাপ– খাস বিলেতে নিশ্চয়ই, এস্থলে ডবল ফাঁসির চেয়েও কড়া আইন আছে।
তুলনা দিয়ে কী প্রকারে বোঝাই? কোনও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ যদি হঠাৎ কোনও এক পরিচিতের বাড়িতে গিয়ে দেখেন তারই এক চেনা চাড়াল তারই গরদ পরে বামুন সেজে পুজোর ঘরে ঘন্টা বাজিয়ে ধুমধাম লাগিয়েছে আর বউঝিরা তাকে টিপটিপ করে পেন্নাম করছে তা হলে তার মনের অবস্থাটা কোন রস দিয়ে বর্ণাতে হয়?
***
কার্জন হুকুম জারি করলেন, ব্যাটাকে যেন অতি ভোরের ট্রেনে চাপিয়ে দেওয়া হয় নাক বরাবর লন্ডন। একটা ঠিকে ভ্যালে যেন তদ্দণ্ডেই জোগাড় করা হয়।
এখানেই শেষ? আদৌ না। এ তো সবে শুরু।
পরদিন সকালে কার্জন খাটে শুয়ে শুয়ে দেখেন, ঠিকে ভ্যালে ওয়ার্ডরোবের দরজা খুলে তার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘাড় চুলকোচ্ছে। অচেনা, নয়া ঠিকে কার্জনও দরদী দিল আদমি, শুধোলেন, কী হল?
কাঁচুমাচু হয়ে বলল, হুজুর, সঠিক ঠাহর হচ্ছে না। পাতলুনগুলো গেল কোথায়!
লক্ষ মেরে কার্জন গিয়ে দেখেন, সত্যিই তো পাতলুনগুলো গেল কোথায়? আছে বটে অনেকগুলো, কিন্তু স্ট্রাইপট অর্থাৎ ডোরাকাটা পাতলুনগুলো কোথায়? সেগুলোর যে এক জোড়াও নেই। আর সেই পরেই তো তিনি যাবেন দুপুরের কনফারেন্সে। খাঁটি ফুল মর্নিং ড্রেস। সামনের দিকে ট্যারা করে কাটা হাঁটুবুল কোট, সেই কাপড়েরই তৈরি ম্যাচ করা কিংবা ফেনসি ওয়াকিট– এই ওয়াসকিটেই সাদা পাইপিং লাগাবেন কি না তাই নিয়ে জীবনমরণ সমস্যায় পড়েছিলেন আমার সুবন্ধু স্যার সিরিল হবজন-জবসন ফর্স-রবার্টসন লন্ডনে এবং তাঁর সঙ্গে সাদায় কালোয়, কিংবা ঈষৎ ধূসর রঙের ডোরাকাটা স্ট্রাইপট ট্রাউজারজ– তার তো কোনও চিহ্নই নেই।
সর্বনাশ! এখন উপায়?
গাঁইয়া পাঠক যতই ধানাইপানাই করি না কেন, আন্মো এখনও তাই তুমি বলবে, কেন অন্য পাতলুন পরে গেলে হয় না? নিশ্চয়ই হয়। যান না আপনি নিচে কপ্পিন, উপরে দুশালা-শাল, মাথায় তুর্কি টুপি, হাতে কমণ্ডলু নিয়ে আধুনিকদের ব্যুফে লান পার্টিতে টালিউডে কে বারণ করছে? সেকথা থাক।
কিন্তু ব্যাটা ভ্যালের চুরি করারই যদি মতলব ছিল কোট-ওয়েসকিট ম্যাচিং-টাই-কলার পেটেন্ট-লেদার জুতো মায় স্প্যাটস এগুলো ফেলে গেল কেন? এস্তেক ডাইমন্ড পিনও যথাস্থানে রয়েছে। উঁহু, তা নয়। নিশ্চয়ই সুদ্ধমাত্র তাদের রাম-ইডিয়েট বানাবার জন্য।
ঝাড়ো টেলিগ্রাফ। পকড়ো রাসকেলকো কঁহি ভি হোয় টেরেন মে–চাহে প্যারিস, চাহে লনদন!
সে না-হয় হল। কার্জনের রোআবে বাঘের দুধের অর্ডার আকছারই যায় টেলিগ্রামে।