আর আরব সম্পূর্ণ নিরাশ হবেই-বা কেন? ক্রুসেডের সময় আরবভূমির এক ক্ষুদ্রাংশ তিনশো বছর ধরে লড়েছে পোপের নেতৃত্বে জমায়েত তাবৎ ইয়োরোপের সঙ্গে এবং শেষ পর্যন্ত তারা হোলিল্যান্ড ত্যাগ করে ফিরে যান যাঁর যাঁর দেশে পোপের কাতর ক্রন্দন, তীব্র অভিসম্পাত উপেক্ষা করে। ইহুদি যদি দু হাজার বছরের মড়া রাষ্ট্রে প্রাণ দিতে পারে, তবে আরবই-বা তার মাত্র এক হাজার বছরের পুরনো রাষ্ট্রশক্তিতে প্রাণ সঞ্চার করতে পারবে না কেন?
তা হলে প্রশ্ন, এ সমস্যার কি কোনও সমাধান নেই?
আছে হয়তো। কিন্তু যে সমাধান এক পক্ষ কিছুতেই স্বীকার করবে না সেটাকে সমাধান বলি কী প্রকারে? তবু দেখা যাক।
যুদ্ধবিরতির সঙ্গে সঙ্গেই মার্কিনিংরেজের শুধু একটি চিন্তা : এই যে আরব-বলদের মড়াটা পড়েছে পায়ের কাছে, এর কতটা অংশ পাব আমি– সিংহ-আন্-স্যাম, কতটা পাবে জনবুল-নেকড়ে, আর কতটা পাবে ইহুদি-ফেউ?- যদ্যপি বেচারি ফেউটাই এস্থলে করেছে লড়াই। কিন্তু সে ফালতু জমিজমা নিয়ে করবে কী? অত ইহুদি পাবে কোথায়? হাতের চেয়ে যে আঁব বড় হয়ে যাবে! আর সে যদি নিতে চায়, নিক। আমরা নেব সিনা, গুদা, কলিজা! শাঁসালো বস্তু। সেগুলো কী, এখখুনি নিবেদন করছি।
বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, বিবিসি যুদ্ধবিরতির প্রথম খবর দেবার ঠিক আট মিনিট দশ সেকেন্ড পর একটি talk-টিপ্পনী বেতারিত করল। বক্তা ইংরেজ ইহুদি কি না জানিনে; তাকে ইহুদি বলে ধরে নিয়ে আমি ইহুদিজাতকে অপমান করতে চাইনে।
নাকি-নাকি ন্যাকা সুরে নিজের স্বার্থ যতখানি গোপন করা যায় তাই করে এবং ইংরেজি ভাষা যে ভণ্ডামির জন্য প্রকৃষ্টতম ভাষা সেকথা যে হটেনটট সাত অবধি গুনতে পারে না সে-ও জানে যা বললেন তার বিগলিতার্থ, এরকম লড়াই বড়ই খারাপ, বড়ই খারাপ। এরকম ফের হতে দেওয়া উচিত নয়, উচিত নয়। এই দেখুন না, এরই ফলে আরব জাত বন্ধ করে দিল সুয়েজ খাল— বলুন তো আমাদের জাহাজ চলাচল করবে কী করে? আবার কসম খেয়ে বসল, তেল বেচবে না আমাদের কাছে ওহ! আমাদের বাস-কারখানা তা হলে চলবে কী করে! আর গালফ-অব-আকাবা, শরুম্-উশ-শেখ সে তো বটেই বটেই। অতএব এ হেন অঘটন যাতে পুনরায় না ঘটে তার জন্য ক. সুয়েজ খাল আন্তর্জাতিক কন্ট্রলে নিয়ে নাও, খ. তাবৎ আরবভূমির তেলেরও এমন ব্যবস্থা কর যাতে করে আসছে দুর্যোগে আরব জাত বস্তুটা নিয়ে ছিনিমিনি না খেলতে পারে এবং গ. কিন্তু গ–অর্থাৎ গালফ অব্ আকাবা সম্বন্ধে টীকাকারের উত্সাহ কম কারণ সেখানে প্রধান স্বার্থ ইজরাএলের। এর অর্থ কী? সুয়েজ খাল কন্ট্রলে এলে ইংরেজকে মাশুল বাবদ এক পৌন্ডের জায়গায় দিতে হবে একটি ফার্দিং (ও! ফার্দিং বুঝি অধুনা দুর্লভ? তা সেটা দারুণ স্বার্থত্যাগ করে ফের টাকশালে বানাতে হবে বইকি! Oh Albion! Consider thy historical self-sacrifice!)। তেল কন্ট্রলে এলে হয় কোনও রয়েলটিই দেব না, নয় ওই দু-একটা ফার্দিং থ্রোন টু দি অ্যারাব-বয়!
লড়াই করে মলো ইজরাএল আর লুটের বেলা এলবিয়ন। এর ঠিক উল্টোটাকে বাঙলায় বলে– হায়, বাঙলা বড়ই নাঈফ শিশুর আধো-আধো ভাষা, ও নিয়ে আদৌ ভণ্ডামি করা যায় না খেলেন দই রমাকান্ত বিকারের বেলা গোবদ্দন। এস্থলে ইজরাএল আগেভাগেই বিকার করে বসে আছে, এবারে দই খাবেন গোবর্দন ইংরেজ মহাজন। তবে এর মধ্যে একটুখানি আশার আলো দেখা যাচ্ছে। অ্যাদ্দিন ইংরেজ বিজিনেস বা শপ-লিফটিং করেছেন অঘা ভারতীয়দের সঙ্গে, শিশু নিগ্রোদের সঙ্গে, ক্যাবলাকান্ত আরবদের সঙ্গে, এবারে চাচা, নয়া ওঝার নয়া নয়া খেল। এরা আণ্ডা না ভেঙে মামলেট বানাতে পারে, দেখলে না, নেই নেই তো নেই, সেই নেই নেই থেকে দ্যাখ তো না দ্যাখ একটা নয়া চনমনে সমূহ রাষ্ট্র ইজরাএল পয়দা করে দিয়ে সপ্রমাণ করে ফেলল, তোমাদের আড়াই হাজার বছরের পুরনো পদার্থবিদ্যা দর্শনের স্বতঃসিদ্ধ something cannot come out of nothing আগাপাশতলা ভুল, বিলকুল ভণ্ডুল। জানি তোমরা হর ডিল বা ঘোড়া বিক্রির জন্য পাঠাবে তোমাদের ঝানু ঝানু স্কটসম্যানদের কিন্তু ওদের খোয়াড়েও আছে গণ্ডায় গণ্ডায় ঝাণ্ড ঝাও স্কটিশ জু– যারা ক্রমান্বয়ে চতুর্দশ পুরুষ স্কটল্যান্ডে জন্মমৃত্যু বিবাহ সেরে স্কটসম্যানদের চুষেছে এবং চুষে ভর্তি পকেটে হুইসিল দিতে দিতে পরশুদিন এই হেথা ইজরাএলে এসেছে। তোমরা যদি সুয়েজখালে নাও চল কইরা দু পয়সা কামাও তবে ইহুদি গোপাল সেখানে স্রেফ ঢেউ গুনে দু আঁজি।
কিন্তু এ সবেতে কিছু যায়-আসে না। সুয়েজ, শম্ উশ-শেখ, তেল এসব নিয়ে আরব লেনদেন করতে হরবত তৈরি। এস্তেক– আমার বিশ্বাস–ইজরাএলের চতুর্দিকে জমাজমি নিয়েও সে দরদস্তুর করতে রাজি আছে, কিন্তু তার একটিমাত্র শর্ত মেনে নিতে হবে।
সে শর্তটি : যেসব আরব চাষা জেলেদের প্যালেস্টাইন থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ইজরাএল তৈরি করেছ তাদের ফিরিয়ে নিয়ে পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিতে হবে।
ইহুদিদের প্যারিস তেল-আভিভ শহর হেসে গড়াগড়ি দেবে। তা কখনও হয়!
উত্তরে আরব বলে, কেন হবে না? তেরশো বছর নয়, তারও বহুপূর্বের থেকে আরব-ইহুদি পাশাপাশি বাস করেছে। পয়গম্বর হজরত মুহম্মদ ইহুদিদের বিশেষ সম্মানের চোখে দেখতেন। নিউ টেসটামেন্টে পাই, ইহুদিরা প্রভু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে মেরেছে এবং তারই ফলস্বরূপ যুগ যুগ ধরে খ্রিস্টানরা তোমাদের অত্যাচার করেছে, এখনও কোনও কোনও দেশে করে আর হিটলারের কথা তুলব না, সে তো বিশ্বজন জানে। অথচ কুরান শরিফে স্পষ্ট বলা হয়েছে, প্রভু যিশু আদৌ ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যাননি। যে কলঙ্ক থেকে আমাদের নির্ভুল আপ্তবাক্য কুরান শরিফ তেরশো বছর পূর্বে তোমাদের বেকসুর মুক্তি দিয়েছে, সেই কলঙ্ক থেকে খ্রিস্টানদের প্রতিভূ হিজ হোলিনিস পোপ তোমাদের মুক্তি দিয়েছেন বছর দুই হয় কি না হয়। গ্রিক অর্থডক্স, কপট, লুথেরিয়ান ইত্যাদি চার্চ এখনও দেয়নি। অর্থাৎ প্রায় এক হাজার ন-শো ত্রিশ বছর ধরে পৃথিবীর সর্ব খ্রিস্টান তোমাদের অপরাধী ধরে নিয়ে যেখানে-সেখানে ঠেঙিয়েছে। তোমাদের নামে কুৎসিত কেলেঙ্কারি কেচ্ছা রটিয়েছে যে, তোমরা তোমাদের এক বিশেষ পরবের দিনে একটি নিষ্পাপ খ্রিস্টান শিশুর গলা কেটে তার রক্তপান করাটা অবশ্য কর্তব্য পুণ্য বলে স্বীকার কর।(১) খ্রিস্টানদের এই ইহুদিবিদ্বেষের জন্য বিশেষ ইংরেজি শব্দ এটি-সেমিটিজম। এবং এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে ইংরেজি ভাষা জরমন থেকে নিয়েছে যুডেনডেসে, সুদূর রুশ থেকে নিয়েছে গ্রম। আরবিতে সেরকম কোনও শব্দ আছে, না আমরা তোমাদের ওপর কখনও কোনও অত্যাচার করেছি? বস্তুত আমাদের নবী মদ খাওয়া এবং সুদ নেওয়া বারণ করে দেওয়াতে এ দুটো মুনাফার ব্যবসা তোমরা একচেটে চালিয়েছ তেরশো বছর ধরে তামাম মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা জুড়ে। এই যে ১৯১৯ থেকে তোমরা মধ্যপ্রাচ্যের ইহুদিদের বার বার তোমাদের হোলি ল্যান্ডে নিমন্ত্রণ জানিয়েছ তাদের সবাই এসেছে? (২) এই গত যুদ্ধের সময়ও আমরা কোনও কোনও জায়গায় বিশেষ পুলিশ মোতায়েন করেছি, পাছে উত্তেজিত জনতা তাদের মারধোর করে। আর তোমাদের সঙ্গে লড়াই করে তো আমরা জেরুজালেম দখল করিনি। লড়াই হয়েছিল খ্রিস্টানদের সঙ্গে। শত্রু যদি আমাদের কেউ থাকে তবে সে খ্রিস্টান। অথচ এই খ্রিস্টানদের সঙ্গে আমরা সম্মিলিতভাবে অক্লেশে লেবাননে রাষ্ট্র পরিচালনা করছি।