কিন্তু রাজা হেরড ছিলেন সুলেমানের চেয়ে পরমুখাপেক্ষী। তিনি ছিলেন রোম সম্রাটের অধীনে পরাধীন রাজা। মিশররানি ক্লেওপাতরা-বল্লভ-রোমশাসক অ্যানটনির কৃপায় তিনি রাজা উপাধি পান ও তাকে রোম সাম্রাজ্যের ক্লান্ট প্রিন্স হিসেবে প্যালেস্টাইন শাসন করতে হত। অ্যানটনির আত্মহত্যার পর তিনি পান রোম রাষ্ট্রপ্রধান কার্যত সিজার) অক্টাভিয়ানের পৃষ্ঠপোষকতা।
অতএব দেখা যাচ্ছে, প্রথম দফায় সুলেমান তাঁর গ্লরি গড়লেন ফিনিশীয় রাজা হিরমের সহায়তায়; তার এক হাজার বছর পর দ্বিতীয় দফেতে রাজা হেরড ইহুদিকুলের গৌরব বৈভব পূর্ণ করে তুললেন রোম-শাসকের সাহায্যে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, সেটাও বিনষ্ট হল ৭০ বছরের ভিতর ও তার পর কেটে গেল আরও দু হাজার বছর। এবারে তৃতীয় দফাতে, ১৯৬৭-এর জুন মাসে ইহুদি প্রবেশ করল বিজয়ী বীরের বেশে প্রাচীন জেরুসলমফ নগরে। পুরোভাগে জঙ্গিলাট দায়ান। বিশ্ব ইহুদি উচ্চকণ্ঠে জয়ধ্বনি করে উঠল, ইনিই মাশিয়হ। –মিসায়া (Meesiah), খ্রিস্টানের যিশু (খ্রিস্ট শব্দের অর্থেও মিসায়া) মুলমানের মসীহ = মাহুদি, হিন্দুর কল্কি।
এবারে তৃতীয় দফাতে এ-মাশিয়হ এ-কল্কির পিছনে কে?
আনকল স্যাম– জনসন!
***
কিন্তু এবারেও যদি ইহুদিরা ফেল মারে তবে আগের এক হাজার, তার পর দু হাজার সেই হিসেবে ফোর্থ চান্স পাবে চার হাজার বছর পরে।
লেখনারম্ভের পডি হয়তো-বা দেড়শো বছর পরমায়ু পেয়ে দাঁড়কাক একশো বছর বাঁচে কি না পরখ করে যেতে পারবে, কিন্তু ইওরস অবিডিয়াটলি এ অধম তো চার হাজার বছর বাঁচবে না! আল্লাকে অসংখ্য ধন্যবান। আমেন।
————
১. তিন হাজার বছর ধরে ইহুদিরা এই মন্দিরের গুণকীর্তন করে করে তার পরিধি ও ঐশ্বর্য এমনই বাড়িয়েছে যে, বাস্তবের সঙ্গে আজ আর তার কোনও মিলই নেই। বাইবেল অনুযায়ীই দেখা যাচ্ছে, মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ২০০ ফুট, প্রস্থ ৭০-এর একটু বেশি (বাইবেল, কিংজ ১; অধ্যায়)! এ যেন সেই লোক মরে লক্ষ লক্ষ কাতারে কাতার! শুনিয়া দেখিনু শেষে আড়াই হাজার ॥
২. বাইবেল, কিংজ ১: ২১। উত্তর গ্যালিলির এই অঞ্চলেই ইজরায়েল-সিরিয়ার হালে সংঘর্ষ হয়। অনুর্বর প্রস্তরময় এই ভূমি কিন্তু বড় ঐতিহাসিক মূল্য ধরে। গ্যালিলি হ্রদের এই উত্তর তীরে যিশু তার প্রথম ও প্রধান প্রচারকার্য আরম্ভ করে টিলার উপরে বসে সারমন অব দ্য মাউনট (ধন্য যাহারা আত্মাতে দীন-হীন, কারণ স্বর্গরাজ্য তাহাদেরই) উপদেশ দেন। এখানেই তিনি সাতখানি রুটি ও ছোট্ট কয়েকটি মাছ দিয়ে চার হাজার লোককে খাওয়ান। এরই কাছে মগদলা গ্রাম, যেখান থেকে নর্তকী, পরে তাপসি মেরি মগডলিন (অস্ফরডের মডলিন কলেজ। maudlin tears; কেনৃবৃরিজের মডলিন বানানে পিছনে e অক্ষর আছে) যিশুর কাছে আসেন…পাঠক যদি অপরাধ না নেন তবে বলি, এখানেই আমি সর্বপ্রথম গ্যালিলির হ্রদের মাছ খাই। তার অপূর্ব স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে এ অঞ্চল সম্বন্ধে সবিস্তর লেখার বাসনা আছে।
সাঙ্গ হয়েছে রণ—
এ-রণ সাঙ্গ হয়নি। সবে আরম্ভ মাত্র। কত শতাব্দী ধরে চলবে কেউ বলতে পারে না। কিংবা কত হাজার বছর ধরে। হাজার বছর ধরে বলছি ভেবেচিন্তেই। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে প্যালেস্টাইনের ইহুদি জাত আপন রাষ্ট্র আপন স্বাধীনতা হারায়। সেই সময় থেকে ইহুদিরা পৃথিবীর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করে। ফলে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে প্যালেস্টাইনের ইহুদি জনসংখ্যা শতকরা পাঁচ থেকে দশের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। ১৯১৯/২০ থেকে পুনরায় ইহুদিদের বহু লোক প্যালেস্টাইনে ফিরে আসতে লাগল। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে (ইহুদি গণনায় ৫৭০৮ সালে অবশ্য এর প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ আছে) ইউনাইটেড নেশনসের অনুশাসনানুসারে প্রাচীন প্যালেস্টাইনের একাংশ নিয়ে ইজরাএল রাষ্ট্র (Erez Jissrael) গঠিত হয়। অর্থাৎ অন্তত আড়াই হাজার বছর লাগল একটা মৃত রাষ্ট্রকে পুনরুজ্জীবিত করতে। তাই এ রাষ্ট্র যদি আবার লোপ পায় তবে হয়তো লাগবে আরও হাজার দুই তাকে পুনরায় প্রাণ দিতে। তাই গোড়াতেই বলেছি, এ সগ্রাম হয়তো চলবে আরও কয়েক হাজার বছর ধরে।
কিন্তু প্রশ্ন, এ রাষ্ট্র কি আবার লোপ পেতে পারে? অতি ক্ষুদ্র যে রাষ্ট্র এতগুলো বিরাট বিরাট আরব রাষ্ট্রকে চারদিনের ভিতর চূড়ান্ত পরাজয় দিল (বস্তুত এক ঘন্টার ভিতরেই আরবশক্তির চোদ্দ আনা জঙ্গিবিমান নষ্ট হয়, এবং ফলে আরবরা কোনও যুদ্ধক্ষেত্রেই সামান্যতম সার্থক আক্রমণ চালাতে পারেনি। সে কি কস্মিনকালেও এদের কাছে পরাজিত হবে? অবিশ্বাস্য।
মাত্র একটি যোগাযোগের ফলে এ বিপর্যয় ঘটতে পারে। এবং উপস্থিত আরবরা যে সন্ধিপত্রেই দস্তখত্ করুক না কেন, তারা সেই মহালগনের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনবে।
সকলেই জানেন, আরব-ইজরাএল দুই পক্ষই লড়েছেন পশ্চিমাগত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। কোনওদিন যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যায় (এবারেও আব্দুন নাসির তাই চেয়েছিলেন কিন্তু রুশ তাঁকে ডোবাল) তবে ইজরাএলের সর্ব সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাবে- এমনকি খাদ্যশস্যও। মিশর-ইরাক তখন লড়বে অনেকটা রুশ যেরকম হিটলারের সঙ্গে লড়েছিল। ইরাক-জরডন হটে হটে যতদূর খুশি যেতে পারে, মিশরের বেলাও তাই। আরব বাহিনী হুবহু রুশদের মতোই কোনও জীবনমরণ সগ্রামে লিপ্ত হয়ে নিজেদের কিছুতেই বিধ্বস্ত হতে দেবে না। এবারেও কোনও কোনও আরব রাষ্ট্র মিশরকে এই ট্যাকটিক বরণ করতে বলেছিল। কিন্তু নাসের জানতেন, ইজরাএল কালক্রমে যদি পরাজয়ের সম্মুখীনও হয় তবে মার্কিনিংরেজ শেষ মুহূর্তে তার পক্ষে নামবেই। আর ইতোমধ্যে প্লেন, তেল, বোমার সাপলাই তো চালু থাকবেই। তাই ভবিষ্যতে আরব রাষ্ট্রপুঞ্জ শুধু তখনই ইজরাএল আক্রমণ করবে যখন গোড়াতেই দেখবে মার্কিনিংরেজ রুশ বা চীনের কিংবা উভয়ের সঙ্গে মরণ-আলিঙ্গনে কণ্ঠ পাকড়ি ধরেছে আঁকড়ি/ দুইজন দুইজনে/। তখন ইজরাএলের সাহায্যের জন্য এরা কড়ে আঙুলটি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারবে না। ইজরাএল অবশ্যই তার প্রতি-ব্যবস্থা বছরের পর বছর করে যাবে, কিন্তু যুদ্ধবিশারদ তথা অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন : ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র যার লোকবল যৎসামান্যেরও কম, যার প্রায় তাবৎ উপার্জন বিশ্ব ইহুদি সংঘের দানখয়রাত থেকে, যার আপন উৎপাদনী শক্তি প্রয়োজন মেটানোর চেয়েও ঢের ঢের কম, তার পক্ষে এ হেন অর্থনৈতিক পলিসি আত্মহত্যার শামিল। তাই আজ থেকে আরব ঠিক এইটেই কামনা করছে।