ফিরিস্তিটি উচ্চাঙ্গের সন্দেহ নেই। গ্রিক, লাতিন, ইতালীয়, ইংরেজ এবং সর্বোপরি ফরাসি কারণ মোপাসাঁ স্বয়ং আঁটি ফরাসিস–মহারথীরা এতে রয়েছেন। কিন্তু সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, চীনা কোনও মহারথীর নাম তিনি করেননি। আরব্য রজনী পর্যন্ত না। কিন্তু আমার আশ্চর্য বোধহয়, ওল্ড টেস্টামেন্টটির কথা মোপাসাঁর স্মরণে এল না কেন? যদিও আশ্চর্য হবার বোধহয় কোনও কারণ নেই। অধুনা আমি আঁদ্রে জিদ-এর জুর্নাল বা রোজনামচাখানা ফের উলটে-পালটে দেখছিলুম, ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত।(৩)
পুস্তকান্তের নিঘণ্টতে দেখি, জিদ প্রায় ছ-শো জন লোকের নাম করেছেন। শতকরা আশিজন সাহিত্যস্রষ্টা। প্রাচ্যদেশীয় একজন লেখকের নামও তার আত্মচিন্তায়, বন্ধুমিলনে, সাহিত্যপাঠে উল্লিখিত হয়নি। অথচ গুণগ্রাহী এই জিদই গীতাঞ্জলি অনুবাদ করেন। ইয়োরোপের প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণবদের কথা হচ্ছে না; ম্যাক্সমুলার, লেভি, উইনটার নিৎস, সাষাও (অল-বিরুনির অনুবাদক) এদের কথা আলাদা, কিন্তু যারা সাহিত্য-রস, কলাসৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করেন, তাঁদের অল্পজনই সে-সব বস্তুর জন্য অস্তাচলে বসে পূর্বাচলের পানে তাকান– গ্যোটে রোলা (তিনিও সুন্দরের চেয়ে সত্যের সন্ধান করেছেন অধিকতর) বড়ই বিরল। প্রতিদিন বিরলতর হচ্ছে। কিছুদিন পরে অবশ্য এদের সম্বন্ধে আমরা আর কোনও খবরই পাব না। বিদেশি বই আসবে না। বিজলি বন্ধ হয়ে গেলে রেডিয়ো সেটের মতো অবস্থা হবে আমাদের।
মূল কথায় ফিরে যাই : মোপাস লিখছেন, রীতিমতো চটে যেতেন ফ্লোবের, যখন আর্ট সমালোচকরা সাহিত্যে নীতি সাধুতার দোহাই পাড়তেন। তিনি (ফ্লোবের) নিজেই বলেছেন, যবে থেকে মানবজাতির সৃষ্টি হয়েছে, সর্ব মহান লেখকই তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে এইসব ক্লীবদের সদুপদেশের (উদ্ধৃতিচিহ্ন অনুবাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
(*Depuis quexiste lhumanite, disait-il, tous les grands ecrivains ont proteste per leurs oeuvres contre ces conseils dimpuissants) (8)
গুরুদত্ত এই আপ্তবচনটি সসম্মান উদ্ধৃত করে মোপাস বলেছেন, সুই, প্রতিষ্ঠিত সমাজজীবনের জন্য সুনীতি তথা সাধু আচরণ অপরিহার্য, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত সমাজের সঙ্গে সাহিত্যের তো কোনও সম্পর্ক নেই। ঔপন্যাসিকের প্রধান লক্ষ্য, মানুষের প্রবৃত্তি পর্যবেক্ষণ করে সেগুলো বর্ণনা করা– তা তার প্রবৃত্তি সুপ্রবৃত্তিই হোক আর কুপ্রবৃত্তিই হোক। নীতিগর্ভ উপদেশ বিতরণ করা কিংবা অভিসম্পাত দেওয়া, অথবা তত্ত্বতথ্যের প্রচার করার জন্য জীবন উৎসর্গ করা তো তার কর্ম নয় (অর্থাৎ এসব প্রচারকর্মের মিশনারি সে নয়)। এ জাতীয় উদ্দেশ্যমূলক কোনও গ্রন্থই আর্টের পর্যায়ে উঠতে পারে না।
তৎসত্ত্বেও কোনও সার্থক গ্রন্থ যদি সুশিক্ষা দানে সক্ষম হয়, তবে সেটা লেখক সেই উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রন্থ লিখেছিলেন বলে নয় (সেটা malgre lauteur inspite of the author, –সেটা লেখকের ইচ্ছা– এমনকি অনিচ্ছাবশত নয়), তিনি যেভাবে ঘটনাগুলো বর্ণনা করেছিলেন, তার অন্তর্নিহিত শক্তির বলেই সে সেই সুশিক্ষা দানে সক্ষম হয়েছে।
অর্থাৎ আন্কল টমস্ ক্যাবিন যদি দাসত্বপ্রথাকে নির্মম আঘাত দিয়ে থাকে, যদি এমিল জোলার জা কুজ(আই এক্যজ=আমি ফরিয়াদ জানাই)(৫) মিলিটারি স্বৈরতন্ত্রকে দ্বিখণ্ডিত করে থাকে, তবে তার কারণ, পুস্তকদ্বয় অনুভূতি সঞ্চারণে এমনই কৃতকার্য হয়েছিল যে, এগুলো তখন আর্টের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আরোহণ করেছে।
মোপাসাঁ বিশুদ্ধ আর্ট, আর্টে শ্লীলতা-অশ্লীলতা নিয়ে আরও অনেক কিছু লিখেছেন, কিন্তু সেগুলো উপস্থিত থাক।
ছুঁৎবাই রোগে আক্রান্ত পদি পিসি সব দেশেই আছেন– তবে ফ্লোবের-মোকদ্দমায় হেরে গিয়ে ফ্রানসের পদি পিসিরা বড়ই মুষড়ে যান। বস্তুত ফ্লোবের-শতাব্দীর শেষের দিকে পেন্ডুলাম অন্য প্রান্তে চলে গিয়েছেন। ফ্রান্সের যে মিনিট্রি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন একদা ফ্লোবেরের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করেছিলেন, তারাই তখন আইন করেছেন, যেসব পুস্তকে ভগবানের উল্লেখ থাকবে, মিনিসট্রি সেগুলো তাদের পাবলিক লাইব্রেরির জন্য কিনবেন না। সে খবর শুনতে পেয়ে কট্টর জাত-নাস্তিক আনাতোল ফ্ৰাস উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, এ আবার কী রকমের লিবার্টি যে লিবার্টি মানুষকে ভগবানের নাম প্রচার করতে দেয় না?
বভারি মোকদ্দমার একশত বছর পর আবার পেন্ডুলাম অন্য প্রান্তে গেছে। টপলেস ডাইনি পোড়াবার জন্য ফ্রান্সেই এখন সবচেয়ে পুলিশের দাপট, নাইটক্লাব টাইট দেওয়াতে এদের উৎসাহ-উত্তেজনার অন্ত নেই। আমাদের অবশ্য তাতে কিচ্ছুটি বলবার নেই।
কিন্তু একশো বছর পূর্বে যে বভারির বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করে মার খেল ফ্রান্স, সেই ফ্রান্সই চেষ্টা করছে এখন, আবার মাদাম বভারির সর্বাঙ্গে বোরকা চাপিয়ে তুর্কিপাশার হারেমবদ্ধ করতে! হিটলার যখন পবিত্র জর্মন ন্যাশনালিজমের দোহাই কেড়ে ইহুদি বই পোড়াতে আরম্ভ করেন তখন এক মার্কিন গুণী বলেছিলেন, জর্মনি পুটস দি ক্লক ব্যাক ফ্রান্সে যে তারই পুনরাবৃত্তি! এ-ও এক নয়া নাৎসিবাদ।
দ্য গল লোকটিকে আমার খুব পছন্দ নয়। যদ্যপি গত যুদ্ধের সময় তাঁর আদর্শ এবং চার্চিলের আদর্শে কোনও পার্থক্য ছিল না, তবু চার্চিল পদে পদে দ্য গলের দম্ভ দেখে অতিষ্ঠ হতেন। প্রধান অভিনেত্রী বা প্রিমা দন্নার মতো তিনি এমনই অতি অল্পেতে ঠোঁট ফোলাতেন, গোসাঘরে আশ্রয় নিতেন(৬) যে, আইজেনহাওয়ারের মতো মাথাঠাণ্ডা মানুষ পর্যন্ত–যিনি কি না মন্টির মতো দেমাকি লোককেও সামলাতে পেরেছিলেন তার এদিকটা লক্ষ করে লেখেন We felt that his qualities were marred by hypersensitiveness and an extraordinary stubbornness in matters which appeared inconsequential to us. My own wartime contacts with him never developed the heat that seemed to be generated frequently in his meetings with many others.(৭)