কিন্তু দোদে যেভাবে (তাঁর লেয়-এ Letters de mon Moulin-এর ইংরেজি অনুবাদ কতবার কত লোক যে করেছেন তার হিসাব নেই, পাঠক অনায়াসে পুরনো বইয়ের দোকানে মূল অনুবাদ জোগাড় করতে পারবেন)(২) সেই জলঝড় ভেঙে পয়দল মিস্ত্রালের গায়ে গিয়ে পৌঁছলেন তার বর্ণনা আমি দেব কী করে? দোরে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনতে পেলেন কবি উঁচু গলায় কবিতা রচনা করে যাচ্ছেন– কী করা যায়? নিরুপায় ঢুকতেই হবে–
মিস্ত্রাল যেন লাফ দিয়ে তার ঘাড়ে পড়লেন–অ্যাঁ! তুই এসেছিস! আর ঠিক আজকেই। কী করে তোর মাথায় সুবুদ্ধিটা খেলল, বল দিকিনি।
তার পর কী হল? বলব না।
শুধু একটি কথার উল্লেখ করি।
খানিকক্ষণ পরে গির্জা থেকে ফিরে এলেন মিস্ত্রালের মা। বুড়ি বড়ই সরলা, রান্নাতে পাকা, কিন্তু হায়, প্রভাসাল ছাড়া কোনও ভাষা বলতে পারেন না। তাই কোনও ফরাসি (যেমন প্রভাঁসের লোক ফরাসি নয়!) ছেলের সঙ্গে খেতে বসলে তিনি তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতেন না কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, তিনি রান্নাঘরে না থাকলে তো রসুইয়ের নিখুঁত তদারকি হবে না।
আরেকটি কথা। মিস্ত্রালের শোবারঘরটি ছিল বড়ই ন্যাড়া। ফরাসি একাডেমি যখন মিস্ত্রালকে তিন হাজার ফ্রাঙ্ক উপহার দিল, তখন বুড়ি চাইলেন ঘরটিকে একটু ভদ্রস্থ করতে।
না, না, সে হয় না–বললেন মিস্ত্রাল– এ যে কবিদের কড়ি; এটা ছুঁতে নেই। ঘরটি ন্যাড়াই থেকে গেল। দোদে বলেছেন, কিন্তু যতদিন ওই কবিদের কড়ি ফুরোয়নি, ততদিন কেউ তাঁর বাড়ি থেকে রিক্ত হস্তে ফিরে যায়নি!
বৃষ্টি হচ্ছিল না? না, আমি স্বপ্ন দেখছিলুম।
তবে কি আমি ডা. বসুর সঙ্গে বসে? না, সে-ও স্বপ্ন।
আমি এসেছি মিত্রালের গ্রামে, বহু বছর পরে, সেই রঁদাগৎ পরে।
আমার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। শুধু একটি দুঃখ রয়ে গেল। যাকে এখানে আসার খবরটি পিকচার পোস্টকার্ডে জানালে খুশি হতেন, তিনি এখন এমন জায়গায় যেখানে এখনও ডাক যায় না।
———–
১. বছর চার পূর্বে বোধহয় খগেন দে সরকার এর অনুবাদ দেশ-এ প্রকাশ করেন।
২. এ লেখক দোদের একটি লেখা সম্প্রতি অনুবাদ করেছে। দু-হারা গ্রন্থ পশ্য। কিন্তু আমার অনুবাদ থেকে মূল যাচাই করতে যাবেন না।
শিলা জলে ভাসি যায়/ বানরে সঙ্গীত গায়
স্বাধীনতা বলুন, উচ্ছলতা নাম দিন, প্যারিস একটি সৎ গুণের জন্য বিখ্যাত। সে চিরকালই স্বাধীন চিন্তা, তথা পীড়িত বিদ্রোহী জনকে আপন নগরে আশ্রয় দিয়েছে। জর্মন কবি হাইনের প্রগতিশীল মতবাদ কাইজার সহ্য করতে পারেননি বলে তাকে আশ্রয় নিতে হয় প্যারিসে এবং জীবনের বেশিরভাগই তিনি কাটান সেখানে। আর এই বছর পঞ্চাশ পূর্বেই বীর সাবরকরকে ফ্রান্সভূমি থেকে ইংরেজ ধরে নিয়ে যায় বলে ফরাসি সরকার তারস্বরে প্রতিবাদ জানায়।(১)
এ শতকে আমাদের পক্ষে সবচেয়ে বড় আরামদায়ক তত্ত্ব-কথা ছিল এই যে, যেসব কূপমণ্ডুক দেশ কোনও বিশেষ ধরনের বই ছাপতে দিত না, সেগুলো ছাপা হত প্যারিসে। তার কিছুটা পাচার হত– যেমন ধরুন লেডি চ্যাটার্লি– ইংল্যন্ড, আমেরিকা, ভারত ইত্যাদিতে, আর বাদবাকিটা ফ্রান্সগত ইংরেজি পড়নেওয়ালা টুরিস্ট গিলত গোগ্রাসে। তখনকার দিনে রোক্কা একটি টাকাতে উত্তম উত্তম গ্রন্থ পাওয়া যেত। এদেশে যারা বিলিতি বই বিক্রি করে, তারা চিরকালই ছিল শাইলকের বাবার বাবা (আশা করি শাইলক জীবিত থাকলে অপরাধ নেবেন না)। ওয়ান সিনার রেইজেৎ এ হানড্রেড–এক পাপীকে দেখে একশো জন পাপপথে যায় আমিও তাই তাদেরই অনুকরণে, যত পারি এসব বই পাচার করে দেশে নিয়ে আসতুম। আমার পক্ষে প্রক্রিয়াটি কঠিন ছিল না। আমি তুলনাত্মক ধর্মতত্ত্বের ছাত্র। কাস্টম কর্মচারী সে যুগে সচরাচর হত গোয়ানিজ ক্যাথলিক। আমি ট্রাঙ্কের সর্বোচ্চ স্তরে রাখতুম একখানা ক্যাথলিক প্রেয়ার বুক এবং একটি মনোহর রোজারি– অর্থাৎ ক্যাথলিক জপমালা। ম্লেচ্ছ মুসলমানদের খ্রিস্টপ্রীতি দেখে ক্যাথলিক কর্মচারী বে-এক্তেয়ার।
সেই প্যারিস মহানগরীতে শত বছর পূর্বে ডকে উঠলেন ফ্লোবের মাদাম বোভারি বগলর্মে। অভিযোগ! তিনি ইমরাল (দুর্নীতি প্রচারকারী), অশ্লীল কেতাব লিখেছেন। সরকার পক্ষের উকিল গাঁটের ছ-পণ খেয়ে যে বক্তৃতা ঝাড়লেন, সেটা শুনে সকলেরই মনে হল, গাঁয়ের পাদ্রিকে বউবাচ্চাসহ খুন করে ওই গাঁয়ের যে একটিমাত্র কুয়ো আছে, তাতে সে লাশগুলো ফেলে দিয়ে জল বিষিয়ে দিলেও বুঝি ফ্লোবেরের অপরাধ এর তুলনায় সোনার পাথরবাটিতে আকাশকুসুম সাজানোর মতো হত।
মোপাসাঁ লিখলেন, ধন্য ধন্য এডভোকেট জেনারেল পিনার! (ড়িমশাই– অবশ্য তিনি মিন করেছেন শুড়ির শালা চামার!)। ফ্রান্সের ইতিহাসে তুমি অমর হয়ে রইলে!
ফ্লোবের খালাস পেয়েছিলেন। আদালতের ওপর জনমত হয়তো প্রভাব বিস্তার করেছিল। কারণ শুধু ফ্রান্স নয়, ফ্রান্সের বাইরেও তখন ওই বই এমনই চাঞ্চল্য জাগিয়েছে যে, তার পূর্বে বা পরে এমনতরো ক-বার হয়েছে সেটা আঙুলে গুনে বলা চলে। গুণীরা বললেন, যা বল, যা কও, বইখানা নিঃসন্দেহে পিস অব আর্ট, শেফ দ্যত্র, মাস্টারপিস।
মোপাসাঁ অতিশয় সবিনয় লিখলেন, সাহিত্যে নীতি? সে আবার কী চিজ বেরুলুম সেই চিজের সন্ধানে যাঁরা মহামানব, যারা সাহিত্যাচার্য তাঁদের কাছে। আরিস্তোফানেস, তেরেনৎস, প্রাউট, আপুলেয়ুস, ওভিড, ভের্গিল, শেকসপিয়ার, রাবলে, বকাচো, লা ফঁতেন, স্যাঁতামাঁ, ভলতের, জঁ জ্যাঁক রসো, দিদেরো, মিরবো, গোতিয়ে, ম্যুসে(২) ইত্যাদি ইত্যাদি একটিমাত্র উদাহরণও পেলুম না এদের কাছে।