হজরত মুহম্মদ একদিন বেদুইনদের সামনে পুরুষকার ও অদৃষ্ট সম্বন্ধে উপদেশ দেওয়ার পর এক বেদুইন তাঁকে শুধাল, তবে কি, হজরত, উটগুলোকে আমরা দড়ি দিয়ে না বেঁধে আল্লার ভরসায় (কিসমতের ওপর ছেড়ে দেব? হজরত বললেন, না, দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে তার পর আল্লার ওপর ভরসা রাখবে। অর্থাৎ আমরা আটঘাট বেঁধে যতই প্ল্যানিং করি না কেন, সকালবেলা বেদুইনের মতোই হয়তো দেখব, উট হাওয়া, প্ল্যান ভণ্ডুল। কিন্তু তবু উট বাঁধতে হয়, প্ল্যানিং করতে হয়।
বৌদ্ধধর্মও নাকি বলেন, মানুষের জীবন নদীস্রোতে নিচের দিকে চলমান গাছের গুঁড়ির মতো; ধাক্কাধাক্কি করে সেটাকে খানিকটে ডাইনে-বাঁয়ে সরানো যায় কিন্তু স্রোতের উল্টোদিকে চালানো যায় না।
এবং কার্ল মারও নাকি বলেছেন, ইতিহাসের নিয়তি নানা সামাজিক প্যাটার্ন পরিবর্তন করতে করতে সর্বশেষে প্রলেতারিয়া-রাজ আনবেই আনবে। মানুষ সজ্ঞানে আপন চেষ্টা দ্বারা তার গতি দ্রুততর করে দিতে পারে মাত্র।
অতএব তর্কবিতর্ক করি, চেষ্টা দিই– কিন্তু জানি, শিক্ষার্থী আজ দোভাষীই হোক, আর ত্ৰিভাষীই বলুক আখেরে সে একটি ভাষাই শিখবে, তাই দিয়ে জ্ঞানার্জন করবে, কাজকর্ম চালাবে।
পাঠককে ফের বলছি, এখানে আমি বাধ্যতামূলক শিক্ষার কথা বলছি। অর্থাৎ জোর করে দেশের তাবৎ স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীকে দুটো বা তিনটে ভাষা শেখাবার চেষ্টা পণ্ডশ্রম। তারা নিছক পরীক্ষা পাস করার জন্য ভাষা শিখবে কিন্তু পরবর্তী জীবনে দ্বিতীয় বা/এবং তৃতীয় ভাষার চাবি দিয়ে ওইসব ভাষার জ্ঞানভাণ্ডার খুলে ওই জ্ঞান জীবনে সঞ্চারিত করে চিন্তাধারাকে বহুমুখী করবে না– অথচ বিদেশি ভাষা শেখার প্রধান উদ্দেশ্য তো ওইটেই।
এবারে একটা উদাহরণ নিই।
নরমানরা ইংল্যান্ড জয় করে সেখানে চালাল ফরাসি ভাষা। শুধু যে রাজদরবারেই ভাষা ফরাসি হয়ে গেল তাই নয়, শিক্ষাদীক্ষার বাহন, সংস্কৃতি বৈদগ্ধের মাধ্যম, নাট্যশালা সঙ্গীতের ভাষা– সবকিছুই তখন ফরাসি এবং ফরাসির মাধ্যমে তার জননী লাতিন। পাকা তিনশোটি বছর চলল ফরাসি ভাষার একচ্ছত্রাধিপত্য। ইংরেজিতেও যে কোনও প্রকারের চিন্তা বা অনুভূতি প্রকাশ করা যায় সেকথা দেশের ভদ্রজন সম্পূর্ণ ভুলে গেল। ফরাসি ভাষা নাকি আল্লাতালা স্বয়ং এমনই মধুর পরমপ্রিয় করে নির্মাণ করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি (এদেশেও আমরা সংস্কৃতকে দেবভাষা খেতাব দিয়েছি এবং সন্ত তুকারাম তাই বক্রোক্তি করেছিলেন, সংস্কৃতি যদি দেবভাষা হয়, মারাঠি কি তবে চোরের ভাষা?।… পুরো তিনশোটি বছর পর ইংল্যান্ডের রাজার মাতৃভাষা আবার হল ইংরেজি কিন্তু হলে কী হয়, ফরাসি যদিও ক্রমে ক্রমে হটে যেতে লাগল তবু দেখা যাচ্ছে এই সেদিন–১৭ শতাব্দী অবধি আইন-আদালতের ভাষা ছিল ফরাসি।(২)
ইংরেজি একদিন পদ পেল বটে, তাই বলে কি ফরাসি কর্তার ভূত কাঁধ থেকে অত সহজে নামে? ইংল্যান্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত M. Ed.-রা বলতে পারবেন কবে বিলেত থেকে ফরাসি কমপালসরি সবজেকটরূপে লোপ পেল। কিন্তু তার পরও, আজ অবধি, ওই ফরাসি অপশনাল হিসেবে পড়াবার জন্য বিলেত প্রতি বছর কত খরচা করে?
এবং আজও ইংরেজ মুখে ফরাসিকে নিয়ে যতই মশকরা করুক না কেন, জেবে দুটো কড়ি জমামাত্রই হলিডে করার জন্য পরানভয়ে হরিণের মতো ছুট লাগায় প্যারিস পানে– মনে আশা সেইসব কুকীর্তি করবে, যেগুলো আপন দেশে করা যায় না–সিম্পলি নট ডান্। ইংরেজি সাহিত্য যে ফরাসি সাহিত্যের কাছে কতখানি ঋণী তার জরিপ করা আমার কর্ম নয়। শব্দবিদ না হয়েও বেপরোয়া আন্দাজে বলি, ইংরেজির শতকরা নব্বইটি চিন্ময় শব্দ (আবস্ট্রাক্ট ভকাবুলারি) হয় ফরাসি নয় ওরই মারফত লাতিন গ্রিক থেকে নেওয়া।
আরও কত শত বাবদে আজও ইংরেজি ভাষা, সাহিত্য, রান্নাবান্না (মেনুটা এখনও ৮০% ফরাসিস; বিফ, মাটন, পর, ভিল, ভেজ = গরু, ছাগল, শুয়োর, বাছুর, হরিণের মাংস– সবকটা শব্দ ফরাসি থেকে এসেছে), আদব কায়দা (R. S. V. P থেকে P PC), মদ্যাদি (কন্যাক থেকে শ্যামপেন) ফরাসির কাছে ঋণী বস্তুত বিলেতে, আজও সভ্যতা ভদ্রতার কোন না বস্তু ফরাসি প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল বা আছে?
***
একদা কতিপয় শিক্ষাবিদ ইংরেজের মনে প্রশ্ন জাগল, সেই যে আমরা ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য শেখানোর জন্য আমাদের দেশে প্রায় হাজার বছর ধরে এত টাকা ঢেলেছি, দেখি তো, তার ফলটা কী হয়েছে? জনৈক ফরাসি ভদ্রলোককে নাবানো হল লন্ডনের রাস্তায়। যারই বেশভূষা আচার-আচরণ দেখে মনে হল লোকটি মার্জিত উচ্চশিক্ষিত তাকেই ফরাসি ভদ্রলোক ফরাসিতে শুধলো, আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, বলতে পারেন, কোনদিকে গেলে সবচেয়ে কাছের টুব স্টেশনে পৌঁছব? কথিত আছে ৯৩ না ৯৭ নম্বরের ভদ্রলোক প্রশ্নটা বুঝতে পারলেন বটে কিন্তু ফরাসিতে উত্তর দিতে পারলেন না। ১০৩ না ১০৭ নম্বরের জনা বুঝি কোনওগতিকে অতি ভাঙা-ভাঙা ফরাসিতে উত্তরটা দিলেন।
এর পর আরও নানা উদাহরণ, নানা যুক্তি দেখিয়ে প্রাগুক্ত গবেষকগণ অতিশয় ন্যায্য প্রশ্ন শুধিয়েছেন, তা হলে ওই পোড়ার ফরাসি শেখাবার জন্য এদেশে অত কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালার কী প্রয়োজন?
***
এ বিষয়টি আরও সবিস্তর আরও উদাহরণ দিয়ে গুছিয়ে বলতে হয়। আমার শক্তি অতিশয় সীমাবদ্ধ। তদুপরি যখন জানি, যা হবার তা হবেই, তখন কেমন যেন উৎসাহের অভাবে কলমের কালি শুকিয়ে যায়। তবু লিখছি, এলোপাতাড়ি হাবিজাবি বিস্তর বেহুদা এক্সপেরিমেন্ট করার পর মার খেয়ে খেয়ে যখন মাত্র একটি ভাষাই বাধ্যতামূলক করা যায় এ তত্ত্বটি আবিষ্কার করব, যা অন্যান্য স্বাধীন দেশ করে ফেলেছে, তখন কেউ যেন না বলে, এ যুগের, অর্থাৎ আমাদের বর্তমান যুগের লোকের বিন্দুপরিমাণ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা শক্তি ছিল না।