হালফিল বিজ্ঞানের জয়জয়কার! এ বিদ্যা ষোল আনা রপ্ত করতে হলে নাকি জরমন ভাষা অবর্জনীয়।
অতি অবশ্য এখানে একটি কথা বলে রাখা উচিত। নিতান্ত কট্টর ভিন্ন কোনও মহামহোপাধ্যায়ই বিধান দেন না যে সর্ববিদ্যার্থীকে ঘাড়ে ধরে সংস্কৃত শেখাতে হবে, কট্টর ভিন্ন কোনও মোল্লা বল্লোকের কল্লা ধরে বিসমিল্লা শেখাতে চায় না। প্রাগুক্ত দোভাষী এবং ত্রিভাষীরা কিন্তু যেসব ভাষা শেখাতে চান, সেগুলো ঘাড়ে ধরে শেখাতে চান। অতএব এই ভাষার রেস্-এ সংস্কৃত ফারসি পালিওয়ালাদের উপস্থিত also ran বলে খারিজ করে দেওয়া যেতে পারে। আমি শুধু নির্ঘণ্ট নিরঙ্কুশ করার জন্য এদের উল্লেখ করলুম।
***
কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী শ্রীযুক্ত ত্রিগুণা সেন আসলে বৈজ্ঞানিক বটে, কিন্তু হিউম্যানিটিজেও তার আবাল্য অনুরাগ। তদুপরি তার কমনসেন্স আছে। অতএব তিনি সার্থকনামা ত্রিগুণধারী (সেন-এর বহুবচন সেন্স বা sense)।
দোভাষী-ত্রিভাষীদের সামনে আরেকটি জীবনমরণ সমস্যা : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম কী হবে? ইংরেজি, হিন্দি, আঞ্চলিক ভাষা– তিনটেরই সমর্থক আছেন।
এই সুবাদে আঞ্চলিক ভাষার সমর্থন করতে গিয়ে শ্রীসেন বলেন (হুবহু বাক্যগুলো আমার মনে নেই বলে শ্রীসেন তথা পাঠকের প্রতি যদি অবিচার করে ফেলি তবে কোনও সজ্জন যেন আমার মেরামতি করে দেন), পৃথিবীর কোন সভ্য স্বাধীন দেশে মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়? শিক্ষামন্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে আমাদের নিবেদন :
একশো বছরও হয়নি কবি হেম বাঁড়ুয্যে লিখেছিলেন–
চীন ব্রহ্মদেশ অসভ্য জাপান।
তারাও স্বাধীন, তারাও প্রধান।
সেই জাপানেও কি কখনও জাপানি ভিন্ন অন্য কোনও ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয়েছে? বস্তুত পাঠক প্রত্যয় যাবেন না, মাত্র কিছুদিন হল ক্যান্সার রোগের এক স্পেশূলিস আমাকে বলেন, ওই রোগের গবেষণা জাপানে যা হয়েছে সেটা না জেনে সে সম্বন্ধে আপটুডেট হওয়া যায় না। এবং ওর সবকিছুই হয় জাপানি ভাষাতে।… কিন্তু অত দূরে যাবার কী প্রয়োজন? আফগানিস্তানের জনসংখ্যা কত? দেশটা কি খুবই মডারুন? না তো। আমি যখন সেদেশে পৌঁছই (১৯২৭) তখন সেখানে সবে প্রথম কলেজের প্রথম বর্ষ আরম্ভ হব-হব করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অরুণোদয় হতে ঢের ঢের দেরি। অথচ পরের বছর যখন ওই ফার্স্ট ইয়ার চালু হল তখন তার মাধ্যম হল ফারসি। কিন্তু বৃথা বাক্যব্যয়। পাঠক একটু অনুসন্ধান করলেই জানতে পারবেন ক্ষুদ্র ফিনল্যান্ডই বলুন আর বলিভিয়াই বলুন, শিক্ষার বাহন সর্বত্রই মাতৃভাষা।
***
এইবারে আমরা পৌঁছলুম রণাঙ্গনের কেন্দ্রভূমিতে।
এই যারা দোভাষী-ত্রিভাষী হয় ইংরেজি নয় হিন্দি কিংবা উভয়ই নিয়ে মাথা ফাটাফাটি করছেন তাঁদের শুধোই–শিক্ষামন্ত্রীর মন্ত্র এবং যন্ত্রের সঙ্গে টায় টায় গলা মিলিয়ে পৃথিবীর কোন সভ্য স্বাধীন দেশে ক-জন উচ্চশিক্ষিত লোক মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য একটি ভাষা– উত্তমরূপে না হোক মধ্যম বা অধমরূপেই— জানে?
আমি জনপদবাসী বা নগরের অর্ধশিক্ষিতদের কথা তুলছিনে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রীতিমতো বিএ পাস করেছে, তাদেরই ক-জন মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য আরেকটি ভাষা পড়তে পারে, শুনলে বুঝতে পারে, লিখতে পারে এবং মোটামুটি সাদামাটা কথাবার্তা বলতে পারে? বলা বাহুল্য, যারা কোনও বিদেশে বেশ কিছুকাল কাটিয়েছে তাদের কথা হচ্ছে না। সেস্থলে সম্পূর্ণ অশিক্ষিত লোকও বিদেশি ভাষা অনেকখানি রপ্ত করে ফেলে আপন আপন মেধা অনুযায়ী।
এদেশের কথাও হচ্ছে না। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি মাত্র সেদিন। যদ্যপি এই কুড়ি বছরেই আমরা কী তীব্র গতিতেই না ইংরেজির খোলস বর্জন করছি– এ বর্জনের জন্য কোনও মেহনত-কেরামতি করতে হয় না, আমাদের চৌকশ গোপখেজুরে আলস্যই এর পরিপূর্ণ ক্রেডিট পায়।(১) এবং এই দেশেই প্রায় সাতশো বছর ফারসি ছিল স্টেট ল্যান্গুইজ– সেইটে একদম পালিশ করে ভুলতে আমাদের একশো বছরও লাগেনি।
ফরাসি দেশের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির কত পারসেন্ট ইংরেজি বই পড়তে পারে? বলতে পারে? এক পারসেন্টও না। মারকিন উচ্চশিক্ষিত লোক– স্কুল-কলেজে আট বছর ফরাসি শিখেছে–ক পারসেন্ট ফরাসি পড়তে-বলতে পারে? ঠিক বিএ পাসের পর? তার দশ বছর পর?
অর্থাৎ স্বাধীন দেশের শিক্ষিত লোককেও দোভাষী করা যায় না। এটা একটা ফ্যাশান স্কুল-কলেজে সেকেন্ড ল্যানগুইজ পড়ানো।
পেটের ধান্ধায় অনেকে দোভাষী হয়– স্কুলে না গিয়েও। মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী তামাম আসাম চষে খায়। ও! মারওয়াড়ের গ্রামে গ্রামে বুঝি সুবোম স্কুলে স্কুলে আসামি ভাষার দিগগজ পণ্ডিত বানানো হয়।
তাই বলি, দোভাষী-ত্রিভাষী– এদেশের শিক্ষিত লোকও হবে না। থাকবে একভাষী। এবারে দোভাষী-লিভাষীর দল আপসের চুলোচুলি ভুলে গিয়ে একজোট হয়ে আমাকে আমি, একভাষীকে মারবেন পাইকিরি কিল। এখন বলুন, আমার ভূমিকাটি কি অতি দীর্ঘ হয়েছিল?
.
০২.
ব্যক্তি-বিশেষের বেলা পুরুষকারই যেরকম শেষ কথা নয়, একটা জাতি বা দেশের বেলাও তাই। আমরা যতই ভেবেচিন্তে পারলিমেনটে তর্কাতর্কি করে, কাগজে কাগজে পাবলিসিটি দিয়ে আটঘাট বেঁধে একটা প্রোগ্রাম বা প্ল্যান চালু করি না কেন, শেষ পর্যন্ত তার ফল যে কী উতরাবে সে সম্বন্ধে আগের থেকে দৃঢ়নিশ্চয় হওয়া যায় না। একটা দেশের ধর্ম, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এগুলো এমনই বিরাট বিরাট ব্যাপার যে এগুলোকে মানুষ আদৌ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কি না সে নিয়ে আমার মনে গভীর সন্দেহের উদয় হয়; মনে হয় কী যেন এক অদৃশ্য নিয়তি মানবসমাজকে শাসন করে চলেছে, তার ওপর আমাদের কর্তৃত্ব যদি-বা থাকে সে অতিশয় যৎসামান্য। তা হলে প্রশ্ন উঠবে, এসব বিষয় নিয়ে আমাদের কি তবে চিন্তা করবার কিছুই নেই? অন্ধ নিয়তিই সব? তার নাম অদৃষ্ট, কর্মফল, কিসমতু যে নামেই তাকে ডাকুন।