এটা কিছু একটা উটকো ফ্যাচাং নয়। পরবর্তী যুগে আমি দেশবিদেশে এস্তেক অতিশিক্ষিত মধ্য ও পশ্চিম ইয়রোপেও এহেন কীর্তন একাধিকবার শুনেছি। দু-জনার কাজিয়া মেটাতে গিয়েছ কি মরেছ। দু-জনা একজোট হয়ে তোমাকে মারবে পাইকিরি কিল।
এ তো গেল সাদামাটা পশুবল প্রয়োগের বর্বরতা ঠেকাবার প্রচেষ্টা। কিন্তু যে স্থলে দুই পক্ষই সাতিশয় শিক্ষিত বলতে কী, যেন দেশমাতৃকার উচ্চতম অনবদ্য শিক্ষিত সন্তান এবং যা হচ্ছে সেটি মার্জিততম বাকযুদ্ধ, সেস্থলেও আপনি যদি ফৈসালা করে দিতে চান তবে ফল একই। উভয়পক্ষ একে অন্যের প্রতি নিক্ষিপ্ত আপন আপন বাক্যবাণ তন্মুহূর্তেই সংবরণ করে আপনাকে করে তুলবেন এজমালি চাঁদমারির টারগেট।
এ তো হল সে-দুর্দৈবের কীর্তন যে স্থলে আপনার নিজস্ব আপন বিশ্বাস অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তৃতীয় মত আপনি পোষণ করেন না; আপনি সে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক সুবিবেচনাসহ প্রণিধান করে সুলে-সুপারিশসহ একটা মধ্যপন্থা বাতলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যেস্থলে আপনি তৃতীয় মত পোষণ করেন সেখানে– ঈশ্বর রক্ষতু!–আপনার অকালমৃত্যু অনিবার্য।
ভূমিকাটি আমার অনিচ্ছায় দীর্ঘ হয়ে গেল, কিন্তু প্রয়োজনাতীত বৃহল্লাঙুল নয়। কারণ ভবিষ্যতেও বহু-বহুবার বহু বাদানুবাদের সম্মুখে আমাকে ঠিক এইভাবেই সরকারি প্রাণ (আজকালে ফ্যামিলি প্ল্যানিঙের জমানায় ওটা আর পৈতৃক নয়, এবং জন্মের পরও দুগ্ধাভাবে, অন্নাভাবে ওটা সরকারের হাতেই সমর্পিত) হাতে নিয়ে এগোতে হবে।
***
একদল গুণীজ্ঞানী বলছেন প্রত্যেক আমি প্রত্যেক শব্দটির ওপর বিশেষ জোর দিতে চাই– অধমের যা কিছু বক্তব্য সে ওই প্রত্যেক (বা তাবত্, কুল্লে) শব্দটি নিয়ে ছাত্রটিকে শিখতে হবে নিদেন দুটি ভাষা। কেউ কেউ বলেন, সে শিখবে (ক) আপন মাতৃভাষা ও ইংরেজি, কেউ কেউ বলেন (খ) মাতৃভাষা এবং হিন্দি। এঁরা ইহলোকের তাবল্লোককে দোভাষী বানাতে চান– একেবারে শব্দার্থে নয় (ইহসংসারে কটা লোকের মাত্র একবারের তরেও প্রফেশনাল দোভাষীর প্রয়োজন হয়?}, ভাবার্থে। তফাত এঁদের মধ্যে এইটুকু : একদল মাতৃভাষা ও তদুপরি ইংরেজি শেখাতে চান, অন্য দল ইংরেজির বদলে হিন্দি। (আর যাদের মাতৃভাষাই হিন্দি তাঁদের কী হবে? সেটা এখনও স্থির হয়নি। তাঁরাই স্থির করবেন। অবশ্যই। কই সে মরদ যার মাতৃভাষা হিন্দি নয় এবং তৎসত্ত্বেও সে হিন্দিভাষীদের সামনে কোনও বাত্ প্রস্তাবও করবে? হায়, আপসোস! কেন হিন্দিভাষী হয়ে জন্মালুম না?)
এ তো গেল দোভাষীর দল।
অন্য দল ত্রিভাষী। এঁরা বলেন, অত ঝগড়া-ফ্যাসাদের কী প্রয়োজন? বিদ্যার্থী তিনটে ভাষাই শিখবে। (গ) মাতৃভাষা, হিন্দি এবং ইংরেজি অর্থাৎ মাতৃভাষা শিখতেই হবে, তার পর কেউ বলছেন সেকেন্ড ল্যানগুইজ হবে হিন্দি, কেউ বলছেন, না, ইংরেজি, আর এই ত্রিভাষীর দল মাতৃভাষা তো খাবেনই, তদুপরি ডুডুও খাবেন, টামাকও খাবেন।
এই দোভাষী ও ত্ৰিভাষীতেই ঝগড়া।
এ ছাড়া আরও বহুবিধ আছেন। যেমন কেউ কেউ বলেন, ভারতীয় সংস্কৃতি, বৈদগ্ধ্য সভ্যতার প্রধান ভাণ্ডার সংস্কৃতে। সেই সংস্কৃতই যদি বিদ্যার্থী না শিখল তবে সে নিজেকে ভারতীয় বলে কোন মুখে? যে বেদ উপনিষদ ষড়দর্শন নিয়ে আমরা নিজে গর্ব অনুভব করি, বিশ্বজনের সামনে তুলে ধরি, সেসবই তো সংস্কৃতে। এবং এই সংস্কৃতই একমাত্র বিদগ্ধ ভাষা যে ভাষা একদা আসমুদ্র হিমাচল আর্য-অনার্য সকলকে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করে রেখেছিল। আজ যদি আমরা সজ্ঞানে স্বেচ্ছায় আমাদের কারিকুলামে সংস্কৃতকে স্থান না দিই এবং ফলে তার মৃত্যু ঘটে তবে ঐতিহ্যবিহীন হটেন্টটে ও ভারতীয়তে একদিন আর কোনও পার্থক্য থাকবে না। যুক্তিগুলো যে খুবই সত্য এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই; কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ সম্প্রদায় রণাঙ্গন থেকে ক্রমেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। সংগ্রামে পরাজিত হওয়ার ফলে নয়। কারণ এঁদের বিরুদ্ধে কেউই সংগ্রাম ঘোষণা করে না– দেশের কর্তাব্যক্তিরা এদের সে অবহেলা করে, just by ignoring এদের hors de combat, রণাঙ্গন থেকে অপসারিত করেন। কারণ সংস্কৃত বাবদে এইসব কর্তাব্যক্তিদের বৃহত্তমাংশ ১০০% ignoramus 1… এরই পিঠ পিঠ মুসলমানরা বলেন, তাজমহল (কোনও মারকিন টুরিস্ট যখন তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে কোনও ভারতীয় হিন্দুকে ওই ইমারতের প্রশংসা করে অভিনন্দন জানায় তখন সে তো মুখ বাঁকিয়ে বলে না, না মশাই এটা আমার দেশের মাটিতে আছে বটে কিন্তু আমার ঐতিহ্যগত সম্পদের অংশ নয়, এটা মোচলমানদের ইউ আর বারকিং আপ দি রঙ ট্রি!), মোগল চিত্রকলা, খেয়াল, ঠুংরি, ফারসিতে লিখিত ভূরি ভূরি ইতিহাসাদি অমূল্য গ্রন্থরাজি ভারতীয় সংস্কৃতির অংশবিশেষ এদের সম্যক চর্চার জন্য ফারসি শেখানো উচিত, এবং ধর্মচর্চার জন্য যে আরবি ভাষা শিক্ষা ভিন্ন নান্য পন্থা বিদ্যতে সে তো স্বতঃসিদ্ধ। সংস্কৃতওলাদের মতো এরাও বারোয়ারিতে কল্কে পান না–উপরে উল্লিখিত একই কারণে …এর পরে আছেন জৈন ধর্মাবলম্বী। এদের ধর্মগ্রন্থ অর্ধমাগধীতে। পার্সিদের ধর্মগ্রন্থ প্রধানত আবেস্তার প্রাচীন পারসিকে। এদেশে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর সংখ্যা নগণ্য কিন্তু তাদের শাস্ত্রীয় ভাষা পালিকে নিরঙ্কুশ উপেক্ষা করলে আমরা বৃহত্তর ভারতে মুখ দেখাতে পারব না। আমার এ নগণ্য জীবনে যে দুটি বিদেশির সঙ্গে আমি একই ডরমিটরিতে কিছুকাল বাস করি তাদের উভয়ই ছিলেন সিংহলের বৌদ্ধ শ্ৰমণ। শ্ৰমণ ধর্মপাল ও শরণাঙ্কর : এদেশে এসেছিলেন পালি ও সংস্কৃত অধ্যয়নের জন্য। এছাড়া শ্যামের রাজগুরুও বার্ধক্যে এদেশে এসেছিলেন তথাগতের আপন দেশে নির্বাণ লাভার্থে। হিন্দুর বার্ধক্যে বারাণসির ন্যায় … এবং আছেন খ্রিস্টসম্প্রদায়, যদ্যপি বাইবেলের আদিমাংশ (পূর্ব মীমাংসাঃ) হিবরুতে ও নবীনাংশ (উত্তম মীমাংসাঃ) গ্রিকে, তথাপি খ্রিস্টানদের সর্বজনমান্য বাইবেলের অনুবাদ ভুলগাতে লাতিন ভাষায়। লাতিন ভিন্ন খ্রিস্ট পাদরির শিক্ষাদীক্ষা অসম্পূর্ণ।