হজরত যখন মক্কায় একেশ্বরবাদ প্রচার করলেন তখন মক্কাবাসী সাড়ে তিনশো দেবতা স্বীকার করত। আরেকটি বাড়লে আপত্তিটা কী? আর নামাজ-রোজাতেই-বা কী? পুজোপাট তারাও করে, আর উপোসটাও স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যুত্তম প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু যেই তিনি প্রচার করলেন, ধনীর উপর ট্যাকশো বসিয়ে সে ধন তিনি গরিবদের, হ্যাভনটদের মধ্যে বিলিয়ে দেবেন তখনই লাগল গণ্ডগোল। ওদিকে হ্যাভনটরা জুটল তার চতুর্দিকে টাকাকড়ি নয়া করে ভাগাভাগি হলে তারাই হবে লাভবান! ধনী আদর্শবাদী জুটলেন অত্যল্পই, মক্কাবাসীরা তখন স্থির করল, একে খুন না করে নিষ্কৃতি নেই।
খ্রিস্টের বেলাও তাই।
তিনিও তার প্রচারকার্য আরম্ভ করেছিলেন সমাজের দরিদ্রতম স্তরের গরিব জেলেদের নিয়ে। আধ্যাত্ম জগৎ তথা নীতিশাস্ত্র সম্বন্ধে যেসব উপদেশ তিনি দিলেন সেগুলো আজও পূর্ণ জীবন্ত কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলছেন, কেউ তোমার জামাটি অন্যায়ভাবে কেড়ে নিলে তাকে স্বেচ্ছায় জোব্বাটিও দিয়ে দিয়ে। এক পুণ্যশীল ধনীকে বলছেন, তোমরা সব কিছু বেচে ফেলে গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দাও।
জেরুসলমের ইহুদি পুঁজিপতির দল তবু এসব গ্রাহ্য করেনি। ইতোমধ্যে সুলেমানমন্দিরের ভগ্নস্তূপের উপর রাজা হেরড দ্য গ্রেট নির্মাণ করেছেন এক বিরাট নবীন ঐশ্বর্যমণ্ডিত য়াহতে-মন্দির। কিন্তু মন্দির হোক আর সিনাগগই হোক, জাত-ইহুদি ওটাকে দু দিন যেতে না যেতেই ব্যবসায়ের কেন্দ্রভূমি করে তুলেছে। সেখানে চলেছে গরু-বলদের কেনাবেচা এবং তার চেয়েও মারাত্মক সুদখোর ইহুদি মহাজনরা সেখানে চালিয়েছে টাকার লেনদেন, সররাফের (ক্ষুদে ক্ষুদে ব্যাঙ্কারের) বাট্টা নিয়ে টাকাকড়ির বদলাবদলি। বস্তুত এইসব পুঁজিপতিরাই তখন পুণ্যভূমির অধিকাংশ তাদের টাকার জোরে কজায় এনে ফেলেছে।
ইহুদিভূমির প্রত্যন্ত-প্রদেশ থেকে সহস্র-সহস্র শিষ্যশিষ্যা, বিশ্বাসী গ্রামবাসী অনুগতজনকে নিয়ে প্রভু যিশু সগৌরবে প্রবেশ করলেন জেরুসলমে। সেখানে গেলেন সেই সর্বজনমান্য মন্দিরে। ব্যবসায়ীদের কারবার দেখে তিনি ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন কি না বলা কঠিন, তবে তার আচরণ থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়।
মহাজন, ক্রেতা-বিক্রেতাদের তিনি ঝেটিয়ে বের করে দিলেন মন্দিরের বাইরে। চতুর্থ সুসমাচার-লেখক সেন্ট-জন্ বলছেন (St. John) তিনি সুতোর দড়ি পাকিয়ে চাবুক বানিয়ে তাদের চাবকাতে চাবকাতে সেখান থেকে তাড়ালেন। টাকার থলেগুলো উজাড় করে ঢেলে দিলেন মাটিতে, ব্যাঙ্কারদের টেবিল করে দিলেন চিৎপাত। বললেন, শাস্ত্রে আছে : আমার ভবনের নাম হবে উপাসনা ভবন; আর তোরা এটাকে করে তুলেছিস চোরের আড্ডা (ডেন্ অব থিভজ )।
সেই সময়েই স্থির করল পুঁজিপতি ও তাদের ইয়ার যাজকসম্প্রদায়– যিশুকে বিনষ্ট করতে হবে, ক্রুশবিদ্ধ করে মারতে হবে।
***
ধনদৌলত-টাকাকড়ি।
অর্থমনর্থম্ বলেন গুণীজন। কিন্তু এ-ও সত্য– অর্থের সন্ধানে বেরুলে অর্থ (টাকাকড়ি) না-ও পেতে পারেন, কিন্তু অর্থ পেয়ে যাবেন অর্থাৎ অর্থটা– মানেটা বুঝে যাবেন। তাই অর্থমর্থমও বটে।
১. আমার বাড়ির সামনে দিয়ে গত সপ্তাহে বিড়িওলাদের মিছিল গেল– বিড়ির পুঁজিপতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে। তারা ইনকিলাব দোহাই পেড়ে বলছিল ইনক্লাব জিন্দা বাদ। শিক্ষিত লোককেও আমি ইনক্লাব উচ্চারণ করতে শুনেছি। আসল উচ্চারণ ইনকিলাব। –লাটা যতদূর চান দীর্ঘ করবেন। তার পর জিন্দাটা হ্রম্বে হ্রস্বে সারবেন। তার পর বাদটা বাদ যতদূর খুশি দীর্ঘ। অর্থাৎ ইন্। কী লা। ব!! জি। দা। বা। দ ॥
২. সর্ব ইনকিলাবের পিছনে যে অর্থনৈতিক কারণ থাকে সেটাই বিপ্লবের একমাত্র কারণ কি না, কিংবা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কারণ কি না, সে আলোচনা এস্থলে থাক।
৩. আমি এস্থলে বুদ্ধ-যিশুর একমাত্র চিন্ময় রূপের মধ্যেই (অর্থাৎ আমরা যে কল্পনার বা আইডিয়ালাইজড বর্ণনার বুদ্ধ-যিশুর ধারণা করি) নিজেকে সীমাবদ্ধ করছি। ওয়েস্ মৃন্ময় দিকটা নিয়ে মন্তব্য করেছেন—
Jesus was a penniless teacher, who wandered about the dusty sun-bit conutry of Judea, living upon casual gifts of food; yet he is always represented as clean, combed and sleek in spotless raiment, erect and with something motionless about him as though he was gliding through the air. এর পর ওয়েলস্ দেখাচ্ছেন, এই মৃন্ময় ছবির ওপরও চিন্ময় ছবির প্রভাব ফেলেছে This alone has made him unreal and incredible to many people who cannot distinguish the core of the story from the omamental and unwise additions of the unintelligently devout. বুদ্ধের সম্বন্ধেও তিনি অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। এ বাবদে হজরত অতিশয় সাবধান ছিলেন।
অল্পে তুষ্ট
০১.
আমার পরিচিত জনৈক সমাজসেবী ভদ্রসন্তান রাত করে বাড়ি ফিরছিলেন। শরট কট করার জন্য যে গলি ধরেছিলেন সেটা প্রায় বস্তি অঞ্চলের মাঝখান দিয়ে এসেছে। হঠাৎ শুনতে পেলেন, পরিত্রাহি চিৎকার– যা এ অঞ্চলে রাতবিরেতে আকছারই শোনা যায়। সমাজসেবীটি একটু কান পাততেই বুঝতে পারলেন, যুগ যুগ ধরে সমাজ স্বামীকুলকে যে হক দিয়েছে এস্থলে সে কুলেরই জনৈক বস্তি-সন্তান সেটি তার স্ত্রীর উপর কিঞ্চিৎ পশুবলসহ প্রয়োগ করছে। এস্থলে সুবুদ্ধিমান মাত্রই তিলার্ধ কাল নষ্ট করে না, কিন্তু আমাদের সমাজসেবীটি একালের যারা সেবার নামে মস্তানি করে তাদের দলে পড়েন না। দরমার ঝাঁপ ধাক্কা মেরে খুলে হুঙ্কার ছাড়লেন, ব্যস, থামো। এসব কী বেলেল্লাপনা হচ্ছে। আমাদের পাবৃলিক স্পিরিটেড ইয়ংম্যানটি নাটকের এর পরের দৃশ্যে অবশ্যই আশা করেছিলেন সেই অবলা মুক্তি পেয়ে তার সামনে নতজানু হয়ে অঝোরে কৃতজ্ঞতাশ্রু ঝরাবে, এবং তিনিও তার দক্ষিণ হস্ত দ্বারা অদৃশ্য বাতাসের একাংশ অবহেলে দ্বিখণ্ডিত করে, বিলক্ষণ, বিলক্ষণ (ইংরেজিতে যাকে বলে নটেটোলনটেটোল) বলতে বলতে আত্মপ্রসাদাৎ ডগমগ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। ও হরি। কোথায় কী? স্বামী-স্ত্রী দু-জনাই প্রথমটায় একটুখানি থতমতিয়ে তার পর বিপুল বিক্রমে হামলা করল তার দিকে। তিনি প্রায় পালাবার পথ পান না। ইতোমধ্যে বস্তির আরও দু-পাঁচজন জড়ো হয়ে গিয়েছে। সমাজসেবী সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন ওদেরও দরদ যুযুধান দম্পতির প্রতি।