মোক্ষম পুরু কাঁচের ছোট একটি গবাক্ষের ভেতর দিয়ে করুণাসাগর এস এস্-রা (তিন থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যেই সব শেষ– আবহাওয়া ও মৃত্যোৎসর্গিত প্রাণীর ওপর নির্ভর করত সময়ের তারতম্য।) যখন দেখত অচৈতন্য শরীরগুলো আর থেকে থেকে হ্যাঁচকা টান দিচ্ছে না, তখন ইলেকট্রিক পাম্প দিয়ে ভেতরকার গ্যাস শুষে নেওয়া হত। বিরাট দরজা খোলা হত।
গ্যাস ম্যাসক্ (ছিদ্রহীন মুখোশ), রবারের হাঁটু-ছোঁয়া বুট পায়ে পরে হাতে হৌস-পাইপ নিয়ে ঢুকত একদল ইহুদি পূর্বেই বলেছি এদের লোভ দেখানো হয়েছে, প্রয়োজনীয় কাজ করে দিলে এদের মুক্তি দেওয়া হবে।
দরজা খোলামাত্র লাশের পিরামিড, এমনকি যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরেছে তারাও, মাটিতে পড়ে যেত না। একে অন্যকে তখনও তারা জাবড়ে আঁকড়ে ধরে আছে। নাকমুখ দিয়ে বেরোনো রক্ত, ঋতুস্রাবের রক্ত, মলমূত্র সব লাশ ছেয়ে আছে, মেঝেতেও তাই। ইহুদিদের প্রথম কাজ হত হৌস দিয়ে সব কিছু সাফসুৎরো করা। তার পর আঁকশি আর ফাঁস দিয়ে মৃতদেহগুলো পৃথক করা। এর পর লাশগুলোর হাত থেকে আংটি সরানো হত, ডেনটিসট্রা এসে সাঁড়াশি দিয়ে মুখ খুলে সোনার, সোনা বাঁধানো দাঁত– দরকার হলে হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে বের করে নিত। মেয়েদের মাথার চুল দু-চারবার কাঁচি চালিয়ে কেটে নিয়ে বস্তায় পোরা হত– পরে কৌচসোফা এই দিয়ে তুলতুলে করা হবে এবং যুদ্ধের অন্যান্য কাজে লাগবে। সর্বশেষ ইহুদি জমাদাররা স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের গোপনস্থলে পরীক্ষা করে দেখে নিত হীরকজাতীয় মহা মূল্যবান কোনও বস্তু লুকোনো আছে কি না।
ন্যুরনবের্গ মোকদ্দমায় বলা হয় যে, কোনও কোনও ক ক-তে লাশের চর্বি ছাড়ানো হত সাবান ইত্যাদি তৈরি করার জন্য, এবং কোনও এক বিশেষ ক কর প্রধান কর্মচারীর শৌখিন পত্নী মানুষের চামড়া দিয়ে ল্যাম্পশেড় তৈরি করাতেন। কিন্তু এগুলো সপ্রমাণ হয়নি। অধমের নিবেদন, অনাহারে অত্যাচারে রোগব্যাধি তথা অসহ মানসিক ক্লেশে ইহুদিদের দেহে তখন যেটুকু চর্বি অবশিষ্ট ছিল, তা দিয়ে একটি কবরেজি বড়িও হয় না।
মণিমাণিক্য অলঙ্কারাদি জর্মন স্টেট ব্যাংকে পাঠানো হত। এ পদ্ধতিতে স্টেট ব্যাংক কী পরিমাণ মাল পেয়েছিলেন তার হিসাব যুদ্ধশেষে নির্ধারিত করা যায়নি। তবে ব্যাংক বেশিরভাগ বিক্রি করে দেওয়ার পরও যা পাওয়া গিয়েছিল তাই দিয়ে যুদ্ধশেষে মার্কিনরা তিনটে বিরাট ভলট কাঁঠাল-বোঝাই করেছিল। এবং একখানা চিঠি থেকে কী পরিমাণ মাল জোগাড় করা হয়েছিল তার কিছুটা হদিস মেলে। স্টেট ব্যাংক সরকারি লগ্নী প্রতিষ্ঠানকে সে চিঠিতে লেখেন, এই দুসরা কিস্তিতে আমরা যা পাঠাচ্ছি তার মধ্যে আছে, ১৫৪ সোনার পকেট-ঘড়ি, ১৬০১ সোনার ইয়ারিং, ১৩২ ডায়মন্ড আংটি, ৭৮৪ রুপোর পকেটঘডি, ১৬০ বিশুদ্ধ ও মিশ্রিত সোনার দাঁত, ইত্যাদি ইত্যাদি অতি দীর্ঘ সে ফিরিস্তি। চিঠি লেখা হয় ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪২-এ। বরং ইহুদিনিধন চালু ছিল ফুল (গ্যাস) স্টিমে ১৯৪৪-এর শেষ পর্যন্ত এবং তার পর মন্দাগতিতে। মার্কিনরা এখনও তাই ঠিক ঠিক মোট-জমা প্রকাশ করতে পারেননি।
কিন্তু এসব জিনিস থাক। যে জিনিসটা জনৈক মার্কিন অফিসারকে অত্যন্ত বিচলিত করেছিল (এবং আমাকেও করেছে) সেটা নিবেদন করার পূর্বে বলি, এই অফিসারটি রীতিমতো হারড় বয়েল্ড ঝাণ্ড– বিস্তর লড়াই লড়েছেন, বীভৎস সব বহু বহু দৃশ্য দেখেছেন, গণ্ডায় গণ্ডায় গুপ্তচরকে তাঁর সামনে তার আদেশে গুলি করে মারা হয়েছে (যুদ্ধের সময় গুপ্তচর নিধন আন্তর্জাতিক আইনে বাধে না); সে-সবের ঠাণ্ডামাথা হিমশীতল বর্ণনা পড়ে মনে হয়, এসব ক্ষেত্রে ভদ্রলোকের নেকটাইটি পর্যন্ত এক মিলিমিটার এদিক-ওদিক হয়নি কিন্তু তার ওয়াটারলু এল যুদ্ধের পর, আউশভিৎস দেখতে গিয়ে, টুরিস্ট রূপে (এখনও এটি সে অবস্থাতেই রাখা আছে– পাঠক নেকট ট্রিপে সেটা দেখে নেবেন। আমি হিম্মৎ করতে পারিনি)। মার্কিন অফিসার গ্যাস চেম্বার, পোড়াবার জায়গা, বন্ধ চুল্লি, খোলা চুল্লি সব– সব দেখলেন। সর্বশেষে গাইড নিয়ে গেল একটা গুদামঘরে, সেখানে নিহত ইহুদিদের অপেক্ষাকৃত কমদামি জামা-কাপড়, জুতো-মোজা সারে সারে সাজানো ছিল।
তারই এক অংশে তিনি দেখতে পেলেন চল্লিশ হাজার জোড়া জুতো। ক্ষুদে ক্ষুদে। নিতান্ত কাঁচা-কচি শিশুদের।
.
এবারে আমরা যে প্রসঙ্গ নিয়ে এ নিবন্ধ আরম্ভ করেছি সেখানে ফিরে যাই।
মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ ড. গিলবারট আউশভিৎস ক্যাম্পের কর্তা হয়েকে আশ্চর্য হয়ে শুধোন, এত অসংখ্য লোককে তোমরা মারতে কী করে? হয়ে বাধা দিয়ে শান্তকণ্ঠে বললেন, আপনি তাবৎ জিনিসটাকে ভুল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। মারাটা তো সহজ। মিনিট পনেরো লাগে কি না লাগে, দু হাজার লোককে মেরে ফেলতে (হয়ে বোধকরি জানতেন না যুদ্ধের শেষের দিকে এক জর্মন ডাক্তার চমৎকার একটি ইনজেকশন বের করেন, এবং মোদ্দা কথা তার দাম ফিনলের চেয়েও কম, ঘাড়ের কাছে সে ইনজেকশন আনাড়িতেও দিতে পারে, শিকার খতম হয় মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভেতর)। কিন্তু আসল সমস্যা, লাশগুলো নিশ্চিহ্ন করা যায় কী করে। বিরাট বিরাট চুল্লি তৈরি করে এবং সেগুলো চব্বিশ ঘণ্টা চালু রেখেও আমরা ওই সময়ের ভেতর দশ হাজারের বেশি লাশ নিশ্চিহ্ন করতে পারতুম না। মনে রাখতে হবে চুল্লি থেকে মাঝে মাঝে হাড় আর ছাই বের করতে হত। হাড়গুলো মেশিনে গুঁড়ো করে ছাইসুদ্ধ পাশের নদীতে ফেলে দেওয়া হত (শুনেছি তো হাড়ের গুঁড়ো আর ছাই উত্তম সার– তবে জর্মনরা এটা বরবাদ করত কেন?– যেস্থলে চুল পর্যন্ত কাজে লাগানো হচ্ছে– লেখক) মোটামুটি বলতে গেলে আমরা আউশভিৎসে ২৭ মাসে ২৪,৩০,০০০ (প্রায় সাড়ে চব্বিশ লক্ষ) লোক মেরেছি।