ইতোমধ্যে ছোটখাটো দু-চারটি ক ক-তে ইহুদি সমস্যার খানিকটে সমাধান হয়ে গিয়েছে। মাঝারি রকমের একটা নিরন্ধ্র হলঘরে ইহুদিদের চাবুক মেরে মেরে ঢোকানো হয়। দরজা বন্ধ করে ছেড়ে দেওয়া হয় মনো-অক্সাইড গ্যাস। আধঘণ্টার ভেতর এদের মৃত্যু হয়। কিন্তু এসব জায়গায় ছ মাসে আশি হাজারের বেশি প্রাণী নিশ্চিহ্ন করা যায় না। তা হলে তো হল না।
হয়েস খাঁটি জর্মনদের মতো পাকা লোক। কাজ আরম্ভ করার পূর্বে সব কটা ক ক দেখে নিলেন। (যুদ্ধশেষে হয়ে এক চাষাবাড়িতে আশ্রয় নেন; সেখানে ধরা পড়েন। নরবে শহরে গ্যোরিঙ, হেস, রিবেট্রপ ইত্যাদির বিরুদ্ধে যখন মিত্রশক্তি মোকদ্দমা চালাচ্ছেন তখন হয়ে সাক্ষীরূপে যা বলেন তার নির্গলিতাৰ্থ-)
আমি ক ক-গুলো পরিদর্শন করে আদপেই সন্তুষ্ট হতে পারলুম না। প্রথমত মনো-অক্সাইড গ্যাস যথেষ্ট তেজদার গ্যাস নয়, দ্বিতীয় চাবুক মেরে মেরে গ্যাস-ঘরে লোক ঢোকাতে হলে বিস্তর লোকের প্রয়োজন, তৃতীয় সেই প্রাচীন সমস্যা– লাশগুলোর সর্বোত্তম ব্যবস্থা কী হতে পারে?
কারণ ইতোমধ্যে দেখা গেল, গ্যাস-ভর্তি লাশ পুঁতলে তারই ঠেলায় গোরের উপরের মাটি ফুলে ওঠে কয়েকদিন অপেক্ষা করে তবে স্টিমরোলার চালানো যায়। তদুপরি লক্ষ লক্ষ লাশের বেশাতি! অতখানি জায়গা কোথায়? আউশভিৎস জায়গাটি ছিল নিকটতম গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে, নির্জনে এবং কাছেপিঠে লোক চলাচলের কোনও সদর রাস্তাও তার গা-ঘেঁষে যায়নি। তবু কেউ সেদিক দিয়ে যাবার সময় সেই বিরাট প্রতিষ্ঠানের দেউড়ির উপরের দিকে তাকালে দেখতে পেত লেখা রয়েছে স্নান প্রতিষ্ঠান, গেট দিয়ে দেখতে পেত, প্রতিষ্ঠানের প্রবেশপথের দু পাশে কাতারে কাতারে শৌখিন মরসুমি ফুলের কেয়ারি। দূর থেকে নৃত্যসম্বলিত হালকা গানের কনসারট সঙ্গীত ভেসে আসছে। কে বলবে সেখানে পৃথিবীর অভূতপূর্ব বিরাটতম নর-নিধনালয়!
মেন রেললাইন থেকে একটা সাইড লাইন করিয়ে নিলেন হের হয়ে তাঁর ক ক পর্যন্ত। যেদিন যে সংখ্যার নরনারী শেষ করা সম্ভব সেই সংখ্যার ইহুদি গরুভেড়ার মালগাড়ির ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয়েছে পোল্যান্ড থেকে, হাঙ্গেরি থেকে, সুদূর রুশ থেকে। এদের খেতে দেওয়া হয়নি; ট্রাকে পানীয় জলের, শৌচের ব্যবস্থা নেই। ট্রাক খোলা হলে দেখা যেত শতকরা আট থেকে দশ-জনা– বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে মরে আড়ষ্ট হয়ে আছে। শীতকালে শুধু জমে গিয়েই এর সংখ্যা দেড়া হয়ে যেত।
এদের নামানো হত রেলকর্মচারীদের বিদেয় দেওয়ার পর।
ইহুদিদের বলা হয়েছে, এখানে এদের বিশেষ ওষুধ মাখানো জলে স্নান করিয়ে গা থেকে উকুন সরানো হবে (ডিলাউজিং)। তারাও দেউড়িতে দেখতে পেত লেখা রয়েছে স্নান প্রতিষ্ঠান। ফুলের কেয়ারি, ঘনসবুজ লন, আর আবহাওয়া উত্তম হলে সেই লনের উপর বসেছে সুবেশী তরুণীদের কনসারট। চটুল নৃত্য-সঙ্গীত শুনতে শুনতে তারা এগুতে রেসেপসনিস্ট-এর কাছে। ইতোমধ্যে দু জন এস এস ডাক্তার ইঙ্গিত করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কারা কর্মক্ষম আর কারা যাবে গ্যাস চেম্বারে। শতকরা পঁচিশ জনের মতো কর্মক্ষম যুবক-যুবতীকে আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হত অন্যদিকে। যুবতী মা-দের কেউ কেউ আপন শিশু হতে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না বলে আপন স্কার্টের ভেতর লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করত কিন্তু হয়ে বলেছেন, এস এস-দের তারা ফাঁকি দিতে পারত না। এদিকে যারা গ্যাস চেম্বারে যাবে তাদের বলা হয়েছে তাদের টাকাকড়ি, গয়না, ঘড়ি, মণিজওহর– মূল্যবান যাবতীয় বস্তু আলাদা আলাদা করে রাখতে, যাতে করে স্নানের শেষে যে যার মূল্যবান জিনিস ঠিক ঠিক ফিরে পায় (দেশ থেকে এদের নিয়ে আসার সময় তাদের বলা হয়েছে, তারা ভিন দেশে নতুন, কলোনি (দণ্ডকারণ্য?) গড়ে তুলবে; আপন দেশে ফিরবার কোনও সম্ভাবনা নেই, তাই–হীরাজওহর টাকাকড়ি সঙ্গে নিয়ে যেতে)। ওদিকে কনসারটে পলকা নৃত্যসঙ্গীত বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে। তামাশাটা পরিপূর্ণ করার জন্য কোনও কোনও দিন এদের ভেতর আবার স্থানীয় নৈসর্গিক দৃশ্যের পিকচার পোস্ট কারড় দেওয়া হত– আত্মীয়স্বজনকে পাঠাবার জন্য, তাতে ছাপা রয়েছে আমরা মোকামে পৌচেছি এবং চাকরি পেয়েছি; এখানে খুব ভালো আছি; তোমাদের প্রতীক্ষা করছি। ইতোমধ্যে কয়েকজন অফিসার হন্তদন্ত হয়ে বলতেন, একটু তাড়াতাড়ি করুন; নইলে পরের ব্যাচকে খামখা বসে থাকতে হবে যে! তার পরই সবাই সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় গিয়ে ঢুকত সেই গ্যাস চেম্বারে।
হয়েস বলছেন, ব্যাপারটা যে কী কখনই কেউই বুঝতে পারত না তা নয়। তখন ধুন্ধুমার, প্রায় বিদ্রোহের মতো লেগে যেত। তখন অন্যান্য ছোটখাটো ক ক-তে যে-রকম বেধড়ক চাবুক মেরে মেরে ঢোকানো হয় তাই করা হত।
একটা হল-এ প্রায় দু হাজারের মতো লোক ঠাসা যেত।
এত লোককে একসঙ্গে শাওয়ার বাথে ঢোকানো হয় তাই দেখে অন্তত তখন, অনেকেরই মনে ভীষণ সন্দেহ জাগত। কিন্তু ততক্ষণে টু লেট। ফ্রিজিডেরের দরজার মতো নিরন্ধ্র বিরাট দু পাট দরজা তখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেয়ালের কাছে যারা দাঁড়িয়েছে তারা শাওয়ারের চাবি খুলে দেখে জল আসছে না।… এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আসতে লাগল অন্য জিনিস… দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর লন-এ উপস্থিত একজনের দিকে ইশারা দেওয়া হত। সঙ্গে সঙ্গে সেই এস এস সেখানে একটা পাইপ খুলে ছেড়ে দিত এক টুকরো নিরেট ক্রিসটেলাইজড সাইক্লন বি গ্যাস।৬ এই বস্তুটি অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসামাত্রই মারাত্মকভাবে গ্যাসে পরিবর্তিত হয়ে পাইপের ভেতর দিয়ে উন্মুক্ত শাওয়ারের ছিদ্র দিয়ে বেরুতে থাকত। এক নিশ্বাস নেওয়া মাত্রই মানুষ ক্লরফরম্ নেওয়ার মতো সংজ্ঞা হারায়। যাদের নাকে তখনও গ্যাস ঢোকেনি তারা তখন চিৎকার আর ধাক্কাধাক্কি করত বন্ধ দরজার দিকে এগোবার জন্য আর যারা দরজার কাছে, তারা আপ্রাণ ঘুষি মারত বন্ধ দরজার উপর। সেই মৃত্যুভয়ে ভীত প্রাণাতঙ্কে উন্মত্ত জনতা দরজার দিকে ঠেলে ঠেলে সেখানে মনুষ্য-পিরামিডের আকার ধারণ করত।