উকিল আমেন : কেন?
ওলেনডরফ : এ পদ্ধতিতে নিহত ইহুদি এবং যারা গুলি ছুড়ত উভয় পক্ষেরই মাত্রাহীন অসহ মানসিক যন্ত্রণা বোধ হত। ইহুদিদের প্রতি কসাই ওলেনডফের এই দরদ অভিনব, বিচিত্র। এই কুম্ভীরাশ্রুর একমাত্র কারণ তিনি তখন নিজেকে ফাঁসিকাঠ থেকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা দিচ্ছেন।
কিন্তু এ-কথা সম্পূর্ণ সত্য, যে-সব এস এস সৈন্য গুলি ছুড়ত তাদের অনেকেই এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার ফলে হঠাৎ সাতিশয় মনমরা হয়ে যেত, মদ্যমৈথুন ত্যাগ করত, অবসর সময়ে সঙ্গীসাথী বর্জন করে এককোণে বসে বসে শুধু চিন্তা করত। হিটলারের আদেশে তাদের গুলি ছুঁড়তে হবে– এ-কথা তাদের স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে। কাজেই তার আদেশ লঙ্ঘনের কোনও প্রশ্নই ওঠে না–বছরের পর বছর তারা ট্রেড় হয়েছে বশ্যতা মন্ত্রে– অবিডিয়েনস্ এবাভ অল– ফুরারের আদেশে কোনও ভুল থাকতে পারে না, আপ্তবাক্যের ন্যায় তাঁর আদেশ অভ্রান্ত, ধ্রুব সত্য।
কিন্তু ওই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাটাও তো নির্মম সত্য!
হাল বয়ান করে হিমলার-যমকে জানানো হল। ইস্পাতের তৈরি সাক্ষাৎ যমদূত-পারা কুচিৎ এস এস-এর নার্ভাস ব্রেক-ডাউনের খবর পেয়ে তিনি উম্মা প্রকাশ করেছিলেন কি না সে খবর জানা নেই। তবে একটা কেলেঙ্কারির খবর অনেকেই জানত; ইহুদি নিধনযজ্ঞের গোড়ার দিকে হিমলারের একবার কৌতূহল হয়, ম্যাস-মারডার– পাইকারি কচুকাটা দেখার। একশো জন ইহুদি নারী-পুরুষকে সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি চালানো হল। সে দৃশ্য দেখে স্বয়ং শ্রীমান হিমলার ভিরমি যাচ্ছিলেন। সঙ্গীরা তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল! স্বয়ং যম যদি মৃত্যু দেখে চোখে-মুখে পাঙাস মারেন তবে বালখিল্য যমদূতেরাকোজ্জাবে মা? এবং আশ্চর্য স্বয়ং হিটলারও চোখের সামনে রক্তপাত সহ্য করতে পারতেন না। এবং প্রাণীহত্যা আদৌ বরদাস্ত করতে পারতেন না বলে তিনি ছিলেন কড়া নিরামিষভোজী। মাংসাশীদের বলতেন শবাহারী।
হিমলারের আদেশে দু খানা বিরাট মোটর ট্রাক তৈরি করা হল। দেখতে এমনি সাধারণ ট্রাকের মতো, তবে চতুর্দিক থেকে টাইট ঢাকা এবং বন্ধ। শুধু বাইরের থেকে একটা পাইপ ভিতরে চলে গেছে। মোটর চালানোমাত্র বিষাক্ত গ্যাস ভিতরে যেতে থাকে, এবং দশ-পনেরো মিনিটের ভেতর অবধারিত মৃত্যু। ততক্ষণ অবধি ভেতর থেকে চাপা চিৎকার আর দরজার উপর ধাক্কা আর ঘুষির শব্দ শোনা যেত। প্রাচীন পাপী ওলেনডর্ফকে আদালতে শুনো হল, ওদের তোমরা ট্রাকে তুলতে কী করে?
ওয়েলডরফ : ওদের বলা হত তোমাদের অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
কিন্তু এ পন্থাতেও এস এস-দের কেউ কেউ সেই প্রাচীন চিত্তাবসাদে ভুগতে লাগল। ট্রাক থেকে বের করার সময় দেখা যেত মৃতদের মুখ বীভৎসরূপে বিকৃত। গাড়িময় রক্ত মলমূত্র। একে অন্যের শরীরে জামা-কাপড়ে পর্যন্ত। একে অন্যকে এমনই জড়িয়ে ধরে আছে যে লোহার আঁকশি আর ফাঁস দিয়ে ছাড়াতে শরীর ঘেমে উঠত, মুখ চকের মতো ফ্যাকাসে হয়ে যেত, মগজে ভূতের নৃত্য আর চিন্তাধারায় বিভীষিকা।
অকল্পনীয় এই খুনে গাড়ি দুটোর অভাবনীয় মৌলিক আবিষ্কারক ডক্টর বেকারকে জানানো হল। আসলে ইনি এস এস-দের চিকিৎসক (এবং স্বয়ং এস এস)। ইনি কিন্তু আমাদের সেই স্ত্রীহন্তা ডাক্তারের মতো নন। তিনি একমেবা করেই প্রসন্ন। ইতি ভূমার সন্ধানে আবিষ্কারক হয়ে গিয়েছিলেন।
ঈষৎ বিরক্তির সুরে তিনি লিখলেন, আমি যে ব্যবহার পদ্ধতি লিখে দিয়েছিলুম (ঠিক যেভাবে তিনি ওষুধের প্রেসক্রিপশনে সেবন পদ্ধতি; ডাইরেকশন ফর ইউজ লিখে থাকেন!) সেভাবে কাজ করা হয়নি। অপ্রিয় কর্ম তড়িঘড়ি শেষ করার জন্য গ্যাসযন্ত্র পরিচালক গ্যাস ছাড়ার হ্যাঁন্ডিলটা একধাক্কায় সর্বশেষ ধাপে নিয়ে যায়; ফলে ইহুদিরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। হ্যাঁন্ডিল ধীরে ধীরে চালালে এরা আস্তে আস্তে আপন অলক্ষে মৃদুমধুর নিদ্রায় প্রথম ঘুমিয়ে পড়ে, শেষনিদ্রা আস্তে আস্তে এবং এতে করে আরও কম। সময়ে এদের মৃত্যু হয়। দরজায় ঘুষি, মলমূত্র ত্যাগ, বিকৃত মুখভঙ্গি, একে-অন্যে মোক্ষম জড়াজড়ি– এসব কোনও উৎপাতই হয় না।
অত্যুত্তম প্রস্তাব। কিন্তু তা হলেও তো বিরাট সমস্যার সমাধান কণা পরিমাণও হয় না। কারণ ফি ট্রাকে মাত্র পনেরো থেকে পঁচিশ জন প্রাণী লাদাই করা যায়। এদিকে হিটলার যে বিরাট সংখ্যার দিকে ঊর্ধ্বনেত্রে তাকিয়ে আছেন, এসব গাড়ি গণ্ডায় গণ্ডায় বানিয়েও তো সেখানে পৌঁছনো যাবে না। ওই সময়েই রাশার কিয়েফ শহরের কাছে প্রায় চৌত্রিশ হাজার প্রাণীকে এদের অধিকাংশই ইহুদি-মাত্র দু দিনের ভেতর খতম করার হুকুম এল, জর্মন কর্মতৎপরতা সে কর্ম সম্পূর্ণ করলও বটে। গ্যাসভ্যান দিয়ে এত লোক অল্পসময়ে নিশ্চিহ্ন করা যেত না।
হিটলার-হিমলারের আদেশে জর্মনির ভিতরে-বাইরে বিশেষ করে পোলানডে অনেকগুলো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পূ (কক) নির্মাণ করা হয়। সর্ব-বৃহৎ ছিল আউশভিৎস্-এ। তার বড়কর্তা ছিলেন শ্রীযুক্ত হয়ে। হিমলার তাকে ডেকে বললেন, ফুরার (হিটলার) হুকুম দিয়েছেন, ইহুদিদের খতম করতে হবে, প্রথমত খুব তাড়াতাড়ি, দ্বিতীয়ত গোপনতম গোপনে। কী পরিমাণ ইহুদিকে খতম করতে হবে মোটামুটি হিসাব হিমলার দিলেন। ইউরোপে তখন এক কোটি ইহুদি; অবশ্য বহু জায়গা হিটলারের তাবেতে নয় বলে অসংখ্য ইহুদিকে পাকড়াও করা যাবে না।