ইহুদি যে এ পৃথিবীর সর্ব দুঃখের কারণ এটা হিটলারের কাছে স্বতঃসিদ্ধ টেনেট অব ফেৎ (অন্যতম মৌলিক বিশ্বাস)। খ্রিস্টান-মুসলমান যেরকম যুক্তি-তর্কের অনুসন্ধান না করে সর্ব সত্তা দিয়ে বিশ্বাস করে ইহসংসারের সব পাপ সর্ব দুঃখ সর্ব অমঙ্গলের জন্য শয়তানটাই দায়ী, হিন্দু যেমন বিশ্বাস করে মানব-জাতির সর্ব যন্ত্রণার জন্য তার পূর্বজন্মকৃত কর্মই দায়ী, ঠিক তেমনি হিটলার তার সর্ব অস্তিত্ব দিয়ে বিশ্বাস করতেন বিশ্বভুবনজোড়া সর্ব অশিবের জন্য ইহুদি জাতটা দায়ী– অন্ধ খঞ্জ বৃদ্ধ অবলা শিশু ইহুদি, সব সব, সবাই দায়ী। তার অন্তরঙ্গ জনকে তিনি অসংখ্যবার বলেছেন ইহুদিকুল ছারপোকা-ইঁদুরের মতো প্রাণী (ভারমিন), ছারপোকা ধ্বংস করার সময় তো কোনও করুণা-মৈত্রীর কথা ওঠে না, ইঁদুরের বেলাও কোনটা ধেড়ে কোনটা নেংটি সে প্রশ্নও অবান্তর।
এ-কথা সত্য আমরা ছারপোকা নির্বংশ করার সময় কোনও বাছবিচার করিনে; এবং যে কোনও প্রকারের প্রাণীহত্যা করলেই যে এদেশের কোনও কোনও সম্প্রদায় আমাদের খুনি বলে মনে করেন সে তত্ত্বও আমাদের অজানা নয়। তৎসত্ত্বেও প্রশ্ন থেকে যায়, সত্যিই মানুষে-ছারপোকাতে কোনও পার্থক্য নেই? এদিকে আবার বহু খ্রিস্টান সাধুসজ্জন ইহুদি-ছারপোকাতে পার্থক্য করতেন বটে কিন্তু সেটা সামান্যই। আমি কাইন এবং আবেলের যে বাইবেল কাহিনী দিয়ে এ নিবন্ধ আরম্ভ করেছি সেটাকে রূপকার্থে নিয়ে ওইসব সাধুসজ্জন কাইনকে ধরেন ইহুদিদের সিনাগগ (ধর্ম প্রতিষ্ঠান) রূপে এবং আবেলকে খ্রিস্ট চার্চরূপে অর্থাৎ ইহুদি তার আপন ধর্মবিশ্বাস দ্বারা প্রবুদ্ধ হয়ে যেখানে খ্রিস্টানকে খ্রিস্টধর্মকে পায় সেখানেই তাকে নিধন করে। ইহুদি ভ্রাতৃহন্তা, সে বিশ্বগ্ন।…পাঠক স্বপ্নেও ভাববেন না, আমি হিটলারের ইহুদি নিধন সমর্থন করছি। আমি এ প্রবন্ধ লিখছি অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে এবং এ স্থলে আমি শুধু তার বিশ্বাসের পটভূমিটির প্রতি ইঙ্গিত করছি; তার মতো আরও বহু বিশ্বাসী যে পূর্ববর্তী যুগেও ছিলেন তারই প্রতি ইঙ্গিত করছি।
তা সে যাই হোক, এইসব ইহুদিদের এক জায়গায় জড় করতে মোটেই বেগ পেতে হয়নি— ছারপোকাতে-ইহুদিতে ওইখানেই তফাৎ, ছারপোকা এক জায়গায় জড় করতে পারলে তো আর্ধেক মুশকিল আসান! গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে ইহুদি মুরুব্বিদের বলা হত, তাবৎ ইহুদি পরিবার যেন এক বিশেষ জায়গায় জড় হয়। তাদের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কলোনি পত্তন করা হবে। তার পর ট্রেনে-মোটরে করে কন্সেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে তাদের দিয়েই একটা লম্বা নালা খোঁড়ানো হত। তার পর আদেশ হত, নালার প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াও। একদল এস এস (ব্ল্যাক শার্ট–হিটলারের খাস সেনাবাহিনী) পিছন-থেকে গুলি করত। অধিকাংশ ইহুদি গুলির ধাক্কায় সামনের নালাতে পড়ে যেত। বাকিদের লাথি মেরে মেরে ঠেলে ঠেলে নালাতে ফেলা হত। সবাই যে সঙ্গে সঙ্গে মরে যেত তা নয়– সবসময় তাগ অব্যর্থ হয় না। এদের কেউ কেউ নালা থেকে হাত তুলে বোঝাবার চেষ্টা করত তারা মরেনি–উদ্ধার লাভের জন্য চিৎকারও শোনা যেত। ওদিকে দৃপাত না করে তাদের উপর নালার মাটি ফের নালাতে ফেলা হত এবং সর্বশেষে তার উপর স্টিমরোলার চালিয়ে দিয়ে মাটিটা সমতল করা হত।
নালা খোঁড়া, তার উপর ফের মাটি ফেলা এ-সব কাজের জন্য ইহুদিই জোগাড় করার জন্য কোনও বেগ পেতে হয়নি। একদল ইহুদিকে এই নিধনকর্মটি দাঁড় করিয়ে দেখানোর পর বলা হত তারা যদি গুলি করা ছাড়া অন্য সর্ব কার্যে, সহায়তা করে তবে তারা নিষ্কৃতি পাবে।… বলাই বাহুল্য এরা নিষ্কৃতি পায়নি। আখেরে ওরা ওই একই পদ্ধতিতে প্রাণ হারায়– সাক্ষীকে ছেড়ে দেওয়া কোনও স্থলেই নিরাপদ নয়।
এইসব নিহতজনের অধিকাংশই বুড়োবুড়ি, ছেলেমেয়ে, কোলের শিশু এবং রুগ্ণ অসমর্থ যুবক-যুবতী। সমর্থদের বন্দিদশায় একাধিক বড় বড় কারখানায় বেগার খাটার জন্য নিয়ে যাওয়া হত। আখেরে, অর্থাৎ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে, যুদ্ধশেষের কিছুদিন পূর্বে এদেরও মেরে ফেলা হয়। যুদ্ধপূর্ব জর্মনিতে ছিল ৫,৫০,০০০ ইহুদি, যুদ্ধশেষে রইল ৩০,০০০। পোলান্ডের সংখ্যা বীভৎসতর; যুদ্ধপূর্বে সেখানে ছিল তেত্রিশ লক্ষ, যুদ্ধশেষে মাত্র ত্রিশ হাজার। এবং আশ্চর্য এই, ত্রিশ হাজারের চোদ্দআনা পরিমাণ লোক আপন দেশ ছেড়ে পুণ্যভূমি ইহুদি স্বর্গ ইজরাএলে যেতে রাজি হয়নি। অনেকেই বলে, জর্মনি আমার পিতৃভূমি (ফাটেলান্ট), এদেশ ছেড়ে আমি যাব কেন? যে পিতৃভূমিতে সে তার অধিকাংশ আত্মজন হারাল তার প্রতি এই প্রেম প্রশংসনীয় না কাণ্ডজ্ঞানহীন একগুঁয়েমির চুড়ান্ত– জানেন শুধু সৃষ্টিকর্তা!
আমি বর্ণনাটা সংক্ষেপে সারলুম, কারণ ইহুদি নিধনের এটা অবতরণিকা মাত্র চলি চলি পা পা মাত্র। যেমন এস এস-দের নিধনকর্মে অভিজ্ঞতা বাড়তে লাগল, হননকর্ম তেমন তেমন সূক্ষ্মতর, বিদগ্ধতর ও ব্যাপকতর হতে লাগল।
ভিন্ন ভিন্ন ক্যাম্পের অধিকর্তা, যারা গুলি মারার আদেশ দিতেন তাদের কয়েকজন যুদ্ধশেষে ধরা পড়েন। তাঁদের একজন ওলেন। মিত্রশক্তি কর্তৃক জর্মনির নরবের্গ শহরে সাক্ষ্যদানকালীন ওলেনডর আসামিপক্ষের উকিল আমেনের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমি এই পদ্ধতির সমর্থন করিনি।