কিন্তু সরকার, রাজা বা ডিটেটর যেখানে বেআইনি খুন করে সেখানে এদের সামনেও সেই সমস্যাই দেখা দেয়। যখন পাইকিরি হিসেবে খুন করা হয় তখন দেখা দেয় আরও দুটি সমস্যা :
১. যাদের খুন করা হবে তাদের মনে সন্দেহ না জাগিয়ে কী প্রকারে তাদের একজোট করা যায়?
২. খুন করার জন্য অল্প খরচে অল্প সময়ে কী প্রকারে বিস্তর লোকের ভবলীলা সাঙ্গ করা যায়?
জর্মন মাত্রই স্ট্যাটিস্টিকসের ভক্ত। একশোটি মেয়েছেলের মধ্যে যদি নব্বইটি কুমারী হয়, এবং দশটি গর্ভবতী হয় তবে তারা টরেটক্কা হিসাব করে বলে এই একশোটি মেয়ের প্রত্যেকটি নব্বই পারসেন্ট অক্ষতযোনি কুমারী এবং দশ পারসেন্ট গর্ভবতী।
হিটলার এই ন্যায়শাস্ত্র অবলম্বন করে বললেন, নব্বই পারসেন্ট তো ইহুদি বাদবাকি দশ পারসেন্ট জিপসি, পাগল (বসে বসে শুধু খায়, লড়াইয়ের ব্যাপারে কোনও সাহায্যই করে না) ইত্যাদি। ওই হল!–জিপসি ও নব্বই পারসেন্ট ইহুদি। হিসাবে মিলে গেল।
দেখা গেল, হিটলারের তাঁবেতে ১৯৪১-৪২ সালে যেসব রাষ্ট্র এসেছে এবং আসছে তাতে আছে প্রায় আশি লক্ষ ইহুদি এখানে আমি জিপসি, পাগল, রুশ, হিটলারবৈরী ফরাসি-জর্মন-রুশ ইত্যাদিকে বাদ দিচ্ছি। হিটলার ডাকলেন হিমলারকে। ইনি পুলিশ, সেকুরিটি, ইনটেলিজেন্স, হিটলারের আপন খাস সেনাদল (এরা দেশের সরকারি সৈন্য-বিভাগের অংশ নয়) কালো কুর্তিপুরা এস এস এবং আরও বহু সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিকারী ফুরার। হিটলার একেই হুকুম দিলেন চালাও, ক-ই-আম্! অর্থাৎ পাইকারি কচুকাটা! নাদির-তিমুর যখন দিল্লিতে এই পদ্ধতির প্রবর্তন করেন তখন কৎল-ই-আমই করেছিলেন। আম= সাধারণ (দিওয়ান-ই-আম তুলনীয়) আর কৎল= কতল। অবশ্য নাদির-তিমুর কল-ই-আম্ করেছেন প্রকাশ্যে, হিটলার-হিমলার করলেন অতিশয় সঙ্গোপনে।(৩) বস্তুত হিমলার ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ যে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন সেটা যেমন অভিনব এবং জটিল তেমনি ক্রুর এবং মোক্ষম। তদুপরি বাইরের থেকে তাবৎ ব্যাপারটা যেন করুণাময়ের স্বহস্তে নির্মিত নিষ্পাপ কবুতরটি; ভিতরে ছিল শয়তানের সাঙাৎ কালকূটে-ভরা বেইমান, অশেষ পাপের পাপী পঞ্চম পাতকী তার চেয়ে বেশি পাপী বিশ্বাসঘাতকী, কালনাগিনী। এ এক অভিনব সমন্বয় : বাইরে কবুতর, অন্তরে বিষধর।
পূর্বেই বলেছি, প্রথম সমস্যা : তাবৎ ইহুদি একত্র করা যায় কোন পদ্ধতিতে? এই মর্মে একটি গোপন সভা আহ্বান করলেন হিমলারের ঠিক নিচের পদের কর্তা হাইডেরিষ বার্লিনের উপকণ্ঠে তার সৌখিন ভিলা ভানজে-তে। এ-সভায় আইষমানকেও ডাকা হয়, যদিও পদগৌরবে তিনি এমন কেষ্টবিষ্ট ছিলেন না। কিন্তু হাইডেরিষ ছিলেন সত্যিকার আদম-শনাস মানুষের জৌরি তিনি জানতেন আইষমান তালেবর ছোকরা, যতই ঝুটঝামেলার ঝকমারি ব্যাপার হোক না কেন, সেটার বিলিব্যবস্থা করে সবকিছু ফিটফাট করে নিতে সে পয়লা নম্বরি। সেই সুদূর স্তালিনগ্রাদ থেকে ফ্রান্সের পূর্ব উপকূল, ওদিকে নরওয়ে থেকে উত্তর আফ্রিকা অবধি সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ইহুদিগোষ্ঠী। আইষমানের ওপর ভার পড়ল আড়কাঠি হয়ে এদের কয়েকটি কেন্দ্রে জড়ো করা।
আইষমান সম্বন্ধে বাংলাতেও বই বেরিয়েছে; কাজেই তার সম্বন্ধে আমাকে বিশেষ কিছু বলতে হবে না। শুধু একটি কথা এখানে বলে রাখি; বাংলা বইয়ে আছে আইষমান পাঁচ লক্ষ ইহুদির মৃত্যুর জন্য দায়ী। এটা বোধহয় স্লিপ। পাঁচ লক্ষ নয়, হবে পাঁচ মিলিয়ন অর্থাৎ পঞ্চাশ লক্ষ।
শব্দার্থে ছলে বলে এবং কৌশলে আইষমান যেভাবে ইহুদিদের জড় করেছিলেন সেটা এত সুচারুরূপে আর কেউ সম্পন্ন করতে পারত না একথা তাবৎ নাৎসি, অ-নাস সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন।
অনেকেই প্রশ্ন জিগ্যেস করেন, আড্ডা–ইহুদিদের প্রতি হিটলারের এই যে আক্রোশ এর তো তুলনা পাওয়া ভার। এর কারণটা কী?
এর উত্তর দিতে হলে তিনভলুমি কেতাব লিখতে হয়। খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তনের কিছুকাল পর থেকেই আরম্ভ হয় খ্রিস্টান কর্তৃক ইহুদি নিপীড়ন (এবং এরাই সর্বপ্রথম নয়– সেই খ্রিস্টজন্মের হাজার তিন বছর আগে থেকে পালা করে, মিশর, আসিরিয়া, ব্যাবিলনিয়া, রোমান সবাই এদের ওপর অত্যাচার করেছে)। মধ্যযুগে স্পেনে একবার এক লক্ষ ইহুদিকে খেদিয়ে আফ্রিকায় ঠেলে দেওয়া হয়, এবং হাজার হাজার ইহুদিকে স্রেফ ধর্মের নামে খুন করা হয়।
কিন্তু হিটলার তো খ্রিস্টান কেন, কোনও ধর্মেই বিশ্বাস করতেন না। পারলে তিনি এ সংসারে কোনও ধর্মেরই অস্তিত্ব রাখতেন না।
হিটলার ইহুদিদের বিরুদ্ধে মাঝে-মিশেলে যুক্তিতর্কের অবতারণা করতেন কিন্তু সেগুলো আকছারই পরস্পরবিরোধী। একদিকে বলতেন, ইউরো-আমেরিকার অধিকাংশ ক্যাপিটাল ইহুদিদের হাতে–যত বেকার সমস্যা, যত রক্তাক্ত বিপ্লব, যত যুদ্ধ ইউরোপে হচ্ছে তার পিছনে রয়েছে ইহুদি পুঁজিপতি। আবার একই নিশ্বাসে বলতেন, যে রুশ-কম্যুনিজম ইউরোপের সভ্যতা সংস্কৃতি ধনদৌলত সমূলে বিনাশ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে তার আগাপাশতলা ইহুদি প্ররোচনায়। অর্থাৎ ইহুদি একাধারে কম্যুনিস্ট এবং ক্যাপিটালিস্ট। এবং যারা তার একমাত্র বই মাইন কাপ (মাই স্ট্রাগল-এর ঠিক ঠিক অনুবাদ নয়– আমার জীবনসংগ্রাম বললে অনুবাদটা মূল জর্মনের আরও কাছাকাছি আসে। মোদ্দা আমি আমার জীবন আদর্শ বাস্তবে পরিণত করার জন্য সর্বপ্রকার বাধা-বিপত্তি সর্ব দুশমনের সঙ্গে যে লড়াইয়ের পর লড়াই যুঝেছি তার ইতিহাস) পড়েছেন তারা জানেন তিনি তার সিদ্ধান্তে দলিলপত্র পেশ করে কখনও সপ্রমাণ করেননি, করবার চেষ্টা দেননি। এর কারণটি অতিশয় সরল।