কিন্তু ততোমধ্যে তার নয়া বাসবরের জন্যে যেটুকু ধরনা দেওয়া, তদবির করা সেটুকুনই-বা করবে কে? অবশ্য আখেরে এস্থলে তদবির করা-না-করা–বরাবর। বসুন্ধরা সর্বত্রই তদ্বির-ভোগ্যা নন–এখানে প্রকৃতি তার আপন গতি নেয়।
সাঁইমুরশিদ কবুল, আমি সব নই। কিন্তু আপনার-আমার মতো ক্ষীণকায় মধ্যশ্রেণির ভদ্রসন্তানকে যদি বিদেশের জেলে ঠেসে দেয় তবে কেঁসে যেতে কতক্ষণ? না-হয় সপ্রমাণ হল, কাইরোর জেলকে আপনি হার মানিয়ে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু বেরুনো মাত্রই তো আপনি সেই ক্রাইমটি ফের করে ফেলেছেন, বিদেশে বিনা পাসপটে আপনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
অবশ্য আপনি তর্ক তুলতে পারেন, মিশর সরকারই আপনাকে রাস্তায় নামিয়ে ক্রাইমটি করছে, সেই কাজের আপনি ইফেকট মাত্র। ততোধিক কুতর্ক করতে পারেন, আজ যদি মিশর সরকারের প্রতিভূ পুলিশম্যান আপনাকে চোদ্দতলা বাড়ির ছাদ থেকে পেভমেন্টে ফেলে দেয় তবে সেটা আত্মহত্যা নয়।
***
কাফেতে এ নিয়ে বিস্তর মাথা-ফাটাফাটি হয়।
একমাত্র তওফিক আফেন্দি চরম অবহেলাভরা সুরে পরম তাচ্ছিল্যসহ মাঝে মাঝে বলছিল, যত সব! কিংবা আদিখেত্তায় মানওয়ারি অথবা ডিমের খোসায় কালবৈশাখী!
শেষটায় বলল, ছোঃ! আমার কাছে নিয়ে এলে না কেন?
নিবেদন করলুম, জানি তুমি একদা ছিলে মুস্তাফা কামালের বিবেকরক্ষক অধুনা ইসমেৎ ইনেনুর অমনিবাস এমবাসেডর, কিন্তু তথাপি।
বলল, যাহঃ! এইটুকু মশা মারতে বাঘের উপরে টাগ! না। কিনে দিতুম। কী আর এমন ক্লেওপাতার গুপ্তধন প্রয়োজন ওই সাসিটুকুর জন্য?
আমি অবাক হয়ে শুধোলুম, সে কী? পাসপর কি হাটের বেসাতি, যে–।
গম্ভীরকণ্ঠে বলল, দেখো, বৎস! তুমি আজহর মাদরাসার ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করো; নাই-বা জানলে এসব জাল-জঞ্জুরির কায়দা-কেতা।
———–
১. পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিবেদন : আশকথা পাশকথা (আর সেটা প্রাণধর্ম) না-শুনে যেসব বে-আড্ডাবাজ অথচ গুণী পাঠক মূল গল্পের খেই ছিনেজোঁকের মতো আঁকড়ে ধরে রাখতে চান তারা যেন ফুটনোটগুলো না পড়েন; কণামাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। অবশ্য তার অর্থ এ-ও নয় যে, মূল লেখা না পড়লে তার সর্বনাশ হবে।
শপ-লিফটারজ কথাটা ইংরেজের ওপর প্রথম আরোপ করেন ছদ্মনামধারী সরস লেখক সাকি।
২. আমার কাইরো-কাফে আশ্রম ওই সময়ে।
৩. ভারতের বাইরের বেদে মাত্রেরই বিশ্বাস তাদের আদিমতম পিতৃভূমি ভারতবর্ষ। তা হতেও পারে। এবং তাদের আর একটি বিশ্বাস, ভারতবর্ষ আগাপাশতলা বেদেদের দেশ, সবাই ঘুরে বেড়ায়, সুতরাং কেউ বাড়ি-ঘরদোর বাঁধে না!
আবার আবার সেই কামান গর্জন!
খুন করার পরেই খুনির প্রধান সমস্যা, মড়াটা নিশ্চিহ্ন করবে কী প্রকারে? সমস্যাটা মান্ধাতার চেয়েও প্রাচীন। আমাদের প্রথম পিতা আদমের বড় ছেলে কাইন তার ছোট ভাই আবেলকে খুন করেন। তাঁর সামনেও তখন ওই একই সমস্যা, মৃতদেহটা নিয়ে করবেন কী? সাধারণ সাদামাটা বুদ্ধি খাঁটিয়ে তিনি সেটাকে পুঁতে ফেললেন মাটির ভেতর। কিন্তু মাটিকে আমরা মা-টিও বলি; তিনি সইবেন কেন এক পুত্রের প্রতি অন্য পুত্রের এরকম নৃশংসতা। তাই পরমেশ্বর কাইনকে বললেন, এ তুমি করেছ কী? মাটির (মা ধরণীর) তলা থেকে তোমার ভাইয়ের রক্ত যে আমাপানে চিৎকার করছে। অর্থাৎ মাটিতে পুঁতেও নিস্তার নেই। তাই পৃথিবীর একাধিক ভাষাতে এটা যেন প্রবাদ হয়ে গিয়েছে। সন্দেহবশত গোর খুঁড়ে লাশ বের করে পোস্টমর্টেমের ফলে যখন ধরা পড়ে লোকটার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল তখন ওইসব ভাষাতে বলা হয়, মৃতের রক্ত বা মা ধরণী মাটির তলা থেকে চিৎকার করছিল প্রতিশোধের জন্য। (১,২)
খুন-খারাবির ইতিহাস যারা পড়েছেন তারাই জানেন লাশ গায়েব করার জন্য যুগ যুগ ধরে খুনি কত-না আজব-তাজ্জব কায়দাকে বের করেছে। অবশ্য খুনি যদি ডাক্তার হয় (না পাঠক, ডাক্তার-বদ্যি-হেকিম চিকিৎসার অছিলায় যে খুন করে তার কথা হচ্ছে না) তবে তার একটা মস্ত বড় সুবিধা আছে। বছর বিশেক পূর্বে বিলাতবাসী এক কালা-আদমি সারজন তার মেম বউকে খুন করে। বাথটাবে লাশ ফেলে সেটাকে ডাক্তারি কায়দায় টুকরো টুকরো করে কেটে ড্রইংরুমের চিমনিতে ঢুকিয়ে দিয়ে সচহ্ লাশটা পুড়িয়ে ফেলে। কিন্তু পাক প্রণালীতে করল একটা বেখেয়ালির ভুল। তখন ভর গ্রীষ্মকাল– ড্রইংরুমে আগুন জ্বালাবার কথা নয়। দু-একজন প্রতিবেশী ওই ঘরের চিমনি দিয়ে যে ধুয়ে উঠেছে সেটা লক্ষ করল। ডাক্তারের বউ যে হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়, সে যে মাঝে মাঝে ডাইনে-বাঁয়ে সাইড-জাম্প দিত, স্বামী-স্ত্রীতে যে ইদানীং আছারই বেহদ্দ ঝগড়া-ফসাদ হত এসব তত্ত্ব পাড়াপড়শির অজানা ছিল না। পুলিশ সন্দেহের বশে সার্চ করে চিমনিতে ছোট্ট ছোট্ট হাড় পেল, চানের টাটা যদিও অতিশয় সযত্নে ধোওয়া-পোছা করা হয়েছিল তবু সূক্ষ্ম পরীক্ষা করে মানুষের রক্তের অভ্রান্ত চিহ্ন পাওয়া গেল।… মোদ্দা ডাক্তারকে ইহলোক ত্যাগ করার সময় মা ধরণীর সঙ্গে সমান্তরাল (হরাইজনটাল) না হয়ে লম্বমান (পারপেনডিকুলার) হয়েই যেতে হয়েছিল।
অবশ্য ডাক্তারের ফাঁসি হওয়ার পর তার আপন লাশ নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তার কারণ ছিল না– কারওরই। যে সরকারি কর্মচারী, অশ্লীল ভাষায় যাকে বলে ব্যাঙম্যান, ডাক্তারের গলার প্রয়োজনাতীত দীর্ঘ প্রয়োজনাধিক দৃঢ় একটি নেটাই সযত্নে পরিয়ে ডাক্তারের পায়ের তলায় টুলটি হঠাৎ লাথি মেরে ফেলে দেয় সে এই অপকর্মটি করেছিল জজ-সাহেবের আদেশে, সামনে ওই ডাক্তারেরই পরিচিত আরেক ডাক্তারকে এবং জেলার সায়েবকে সাক্ষী রেখে। শুনেছি, এদেশের সরকারি ফাঁসুড়ে আসামির গলায় দড়ি লাগাবার সময় তাকে মৃদুকণ্ঠে বলে, ভাই, আমার কোনও অপরাধ নিও না; যা করছি সরকারের হুকুমে করছি। ইয়োরোপীয় ফাঁসুড়েদের এরকম ন্যায়ধর্ম-জাত কোনও সূক্ষ্মানুভূতি নেই। সেখানে ফাঁসুড়ে তার মজুরির ওপর ফাঁসির দড়াটা বকশিশ পায়, এবং সে সেটা ছোট ছোট টুকরো করে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে আক্ৰাদরে বেচে ফাঁসির দড়ি নাকি বড় পয়মন্ত।