সে কথা পরে হবে। উপস্থিত থোই, বিদেশে-বিভুঁইয়ে কেউ কখনও পাসপরট হারিয়েছে সকলেই একসঙ্গে শিউরে উঠলেন, কারও কপালে ঘাম দেখা দিল, কেউ-বা দেখি বন্ধ করে আল্লারসুলের নাম স্মরণ করছেন।
পাঠককে বুঝিয়ে বলি, এ সংসারে নানান ভয়াবহ অবস্থা আমরা দেখি, কাগজে পড়ি, শ্রবণ বা স্বল্পলব্ধ জ্ঞান না-হয় বাদই দিলুম। কিন্তু এ সবকটাকে হার মানায় মাত্র একটি নিদারুণ দুর্দৈব–বিদেশে পাসপটটি হারানো।
ছুটুন কনস্যুলেটে। তারা কানই দেবে না। লিখুন আপন দেশে। নো রিপলাই। কিংবা শুধোবে, পাপরূটের নম্বর ইস্যুর তারিখ গয়রহ জানাও। সেগুলো আপনি ডাইরিতে টুকে রাখেননি। আবার কনস্যুলেটে ধন্না। সঙ্গে নিয়ে গেছেন দু-পাঁচজন ভারতীয়। তাঁরা হলপ খেলেন, আপনি যে ভারতীয় সে বাবদে তাদের মনে কোনও সন্দেহ নেই। কনস্যুলেট বলবে, মাডাগাসকারের বিস্তর লোক ভারতীয় ভাষায় কথা কয়; তাই বলে তারা ভারতীয় ইনডিয়ান নেশনালিটির প্রমাণ কোথায় যে আমরা নয়া পাসপ দেব? বের করুন বার্থ সারটিফিকেট, এবং প্রমাণ করুন সেটা আপনারই।
হাজারোগণ্ডার হাবিজাবি হেনাতেনা চাইবে। এবং তাদের চাওয়াটা সম্পূর্ণ ন্যায্যতঃ হকৃতঃ। না চাইলে দুনিয়ার যত ভাগাবন্ড ব্লাডিভসটক থেকে আলসকা–এসে কিউ লাগাবে একখানা করকরে, ঝা চকচকে, সোঁদা সোঁদা গন্ধওলা ইনডিয়ান পাসপরুটের লোভে। এক ঝটকায় হয়ে যাবে ইনডিয়ান ন্যাশনাল, সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে গিয়ে মহারানির মোলাকাৎ চাইবে। যে বেচারাকে টারক তওফিক দেখেছিল পথিমধ্যে, সে সত্যি সিলেটের লোক।
আমি গিয়েছিলুম কনস্যুলেটে, প্যালেসটাইন যাবার জন্য অনুমতির (ভিজার) সন্ধানে। সেই জরাজীর্ণ লোকটাকে জবুথবু হয়ে এককোণে বসে থাকা অবস্থাতে দেখেই বুঝে গেলুম লোকটা সিলেটি।
এবং তাই। আমার মুখে সিলেটি শুনে ভ্যাক করে কেঁদে ফেলল। আমি একপাল লোকের সামনে মহা-অপ্রস্তুত।
ব্যাপারটা সরল, কিন্তু পরিণামে হয়ে গেছে বেজায় জটিল। মাসখানেক পূর্বে আলেকজান্দরিয়া বন্দরের কিছু দূরে একটা জাহাজডুবি হয়–ও-ই কোনও গতিকে বেঁচেছে, সম্পূর্ণ উলঙ্গাবস্থায়, গায়ের চামড়াও কিছুটা পুড়েছে। পাসপর তো সাপের মণি–রত্তিভর ডকুমেন্ট তার কাছে নেই। আর ওই একমাত্র সিলট্যা ভিন্ন অন্য কোনও ভাষায় একটি শব্দও সে বুঝতে পারে না।
কুল্লে কাফে মাথা নেড়ে সায় দিলে, ব্যাপারটা সঙিন।
ভাগ্যিস, ডেপুটি কনসালটি ছিলেন আমার পরিচিত–অতিশয় অমায়িক খানদানি ইংরেজ ভদ্রলোক। আমার আপন কাজ শেষ হয়ে গেলে খালাসিটার কথা পাড়লুম। সায়েব মাথা নেড়ে বললেন, বিলকুল হুম্বগ। আমি কলকাতায় কাজ করেছি পাঁচটি বছর। বাঙলা শুনলে বেশ বুঝতে পারি। ও যা বলল সে তো বাঙলা নয়।
মনে মনে আমাকে বলতে হল, পোড়া কপাল আমার। সাহেবকে বললুম, ওকে একটু ডাকলে হয় না? সায়েব সদাশয় লোক, বললেন, আলবৎ।
লোকটা আসামাত্রই আমি চালালুম তোড়সে সিলেটি। কিঞ্চিৎ কটুকাটব্যের কাঁচা লঙ্কা মিশিয়ে। উদ্দেশ্য তাকে একটু অতিশয় তাতিয়ে দেওয়া, নইলে যেরকম নসিকে ভিলেজ ইডিয়ট, পেটে বোমা মারলেও–। দাওয়াই ধরল। কাইকুঁই করে বলে গেল অনেক দুঃখের কাহিনী–চোখে সাত দরিয়ার নোনাজল। মিনিট পাঁচেক চলল রসালাপ। সায়েব খালাসিকে বললেন, টুম যাও। আমাকে শুধোলেন, এ-ও বাঙলা? আমি বললুম, লন্ডনের সঙ্গে উত্তর স্কটল্যান্ডের ভাষায় যে মিল–এ বাঙলার মিল কলকাত্তাইর সঙ্গে তার চেয়েও কম।
এর পর সায়েব যা বলল, তার থেকে পরিষ্কার বুঝে গেলুম, লোকটি সত্যকার ডিপলমেট। বললেন, দু-একটা শব্দ যে একবারেই বুঝতে পারিনি তা নয়। তবে কি জানো, ব্যাবু, ব্যাপারখানা আসলে কী? কোনও বিশুদ্ধ স্ট্যান্ডার্ড ভাষা–যেমন মনে করো প্যারিসের ফরাসি, কিংবা ধরো লন্ডনে প্রচলিত খানদানি ঘরের ইংরেজি সেটা শেখা কিছু অত্যধিক কঠিন কর্ম নয়। হাজার হাজার রুশ, পোল, হাঙগেরিয়ান চোস্ত ইংরেজি বলে খাসা ফরাসি কপচায়–কার সাধ্যি বলে কোনটা কার মাতৃভাষা নয়–এবং প্রসঙ্গত বলি, এরাই হয় বেস্ট স্পাই। কিন্তু মশাই, বিশুদ্ধ গাইয়া ডায়লেকট রপ্ত করাটা বড়ই কঠিন, প্রায় অসম্ভব। লন্ডনের কটা খানদানি ইংরেজই বলতে পারে খাঁটি ককনি?
সায়েবটি ছিল একটু দুঁদে টাইপ। খালাসিটার জন্মভূমির গ্রাম থানায় চিঠি না লিখে রেডটেপিজেমের মূর্ত প্রতীক এনকোয়ারি না করেই আপন জিম্মায় ছেড়ে দিল একখানা পাসপরুট।
নইলে ওই হতভাগা ক মাস ধরে কে জানে, হয়তো বারো বছর ধরে আপিসে দফতরে ধন্না দিত, রাস্তায় রাস্তায় ফ্যা-ফ্যা করে করে বেড়াত, খেত কী, মাথা গুঁজত কোথায়?
আর ইতিমধ্যে যদি কোনও সমধিক কর্মনিষ্ঠ তথা অত্যুৎসাহী উৎকোচাশ্রয়ী মিশরি পুলিশম্যানের নজরে পড়ে যেত? কাঁধে খাবলা মেরে শুধোত, তুমি তো বিদেশি বলে মনে হচ্ছে হে–নিকালো বাসবর (আরবিতে প নেই বলে ব আদেশ, এবং শব্দটি আরবরা ফরাসি থেকে নিয়েছে বলে শেষের টি উচ্চারিত হয় না–একুনে পাসপ উচ্চারিত হয় বাসবর, বা বাসাবর) তা হলে?
শ্রীঘর। তাতে যে আমাগো সিলট্যা মোতিমিয়ার খুব একটা ভয়ঙ্কর আপত্য (আপত্তি শব্দের সিলেটি রূপ) আছে তা নয়; জাহাজের কয়লাঘরের কারবালায় কারবার করছে যে লোক তার পক্ষে কাইরোয় কারাগার করীমা বখশায় বর হাল-ই-মা–আল্লার কৃপা তার ওপরে এসেছে।