তখন করি কী?
কথিত আছে, একদা লন্ডনে মারকিন হেনরি ফোরড দাবড়ে বেড়াচ্ছিলেন খাসা রহিসি রোলস রইস। পঞ্চম জরজ তাঁকে শুধোলেন, সে কী মিসটার ফোরড! আপনি বিজ্ঞাপনে বলেন ফোরড গাড়ি দুনিয়ার চিপেস্ট এবং বেস্ট গাড়ি, তবে রোলস চড়েন কেন? ফোরড বাও করে বললেন, আমার ম্যানেজারকে বহুবার বলেছি, আমাকে একখানা ফোরড গাড়ি দিতে। তার মুখে ওই এক কথা–ফোরড গাড়ি তৈরি হতে-না-হতেই সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যায়; সে খদ্দের সামলাবে না মালিককে গাড়ি দেবে। খদ্দের মোর ইমপরটেনট দ্যান মালিক। অতএব, হুজুর বাধ্য হয়ে বাজারের সেকেন্ড বেস্ট মোটর–রোলস–কিনেছি।
গল্পটি মিশরের পিরামিডের চেয়েও প্রাচীন–যে পিরামিডের দিকে পিছন ফিরে আমরা কাইরোর কাফেতে বসি। কিন্তু ক্লাসিক্যাল কাহিনীর ভালে ওই তো চন্দন-তিলক! নিত্য নিত্য নব নব ফাড়া গরদিশে সাক্ষাৎ মুশকিলআসান।
আমি জানতুম, অকসব্রিজ ত্রৈমাসিকের পরেই সেকেন্ড বেস্ট কাগজ দেশ। সেখানে পাঠালুম। ছাপা হয়ে গেল (সম্পাদক-ম্যানেজার হয়তো সোল্লাসে ভেবেছিলেন, ওটা পয়সা কামানেওলা বিজ্ঞাপন), বই হয়েও বেরুল। পাঠক সাবধান! চীনেবাদামের ঠোঙা কদাচ অবহেলা করবেন না। একমাত্র ওই কাগজেই একখানা তাবল্লোক মল্লিখিত কাইরোর কাফে আড্ডা সম্বন্ধে নিবন্ধগুলো পড়তে পায়।
অতএব কাইরোর কাফে-আড্ডার সবিস্তর বর্ণনা নতুন করে দেব না। শুধু এইটুকু বলব কাইরোর কাফের তুলনায় আমাদের আড্ডা, ইংরেজের ক্লাব, জরমানের পাব, কাবুলির চা-খানা, ফরাসির বিরো–এস্তেক অবিমুক্ত ক্ষেত্র কাশীর জমজমাট ঘাট–সব শিশু শিশু। বৈজ্ঞানিক বলেন, আমাদের জীবনের এক-তৃতীয়াংশ কাটে শয্যায়–ন্দ্রিায়। কাইরোর কাফে হাসবে–কুট্টির ঘোড়ার মতো–আস্তে বলুন। তাদের জীবনযাত্রা একপ্রকার :
সকাল ৬টা থেকে ১০টা কাফে = ৪ ঘণ্টা। ১০টা থেকে ১টা দফতর। ১টা থেকে ২টা কাফে =১ ঘণ্টা। ২টা থেকে ৫টা দফতর, ৫টা থেকে ১২টা রাত কাফে = ৭ ঘণ্টা। ১২টা থেকে ৬টা ভোর নিদ্রাযোগে গৃহবাস অতিশয় অনিচ্ছায়।
একুনে, সর্বসাকুল্যে কাফেতে ১২ ঘণ্টা। জীবনের এক-তৃতীয়াংশ না ঘন্টা! হোলি রাশার সেই ফাটা ঘণ্টা যেটা কখনও বাজেনি।
কাইরো সজ্জনের জীবনের হাফ কাটে কাফেতে–অবশ্য বেটার হাফ-কে বাড়িতে রেখে! আর ছুটিছাটা, স্ট্রাইক রাজা ফারুকের মেহেরবানিতে হরবকৎ লেগেই আছে(২)–লটারি উত্তোলন দিবসচয় যদি হিসাবে নেন তবে সেই প্রথম প্রবন্ধের প্রথম তত্ত্বে ফিরে যাই : বাড়ি নিয়ে কি গুলে খাব, পারেন তো দিন একটি ননস্টপ-আড্ডার সন্ধান। তা হলে অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে, কাইরোতে লোকে বাড়ি বানায় কেন? মিশরবাসী তখন বিদেশিকে বুঝিয়ে বলে, প্রাচীন যুগে তারা আদৌ বানাত না, বানাত গোরের জন্য স্রেফ পিরামিড–চোখ মেললেই এখনও চতুর্দিকে দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু কই সে যুগের বাড়ি বাড়ি বানানোর বদ-অভ্যাস বাজে-খরচা তারা শিখেছে হালে, ইংরেজের কাছ থেকে, তার হোম নাকি তার কাসল (অ্যান্ড হি ইজ দ্য টাইরেন্ট ইনসাইড) আর বাড়ি বানানোটাই যদি এমন কিছু জব্বর মহষ্কর্ম, বাবুইকেই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী বলা উচিত, ওর মতো নিটোল, নিখুঁত বাড়ি বানিয়েছে আর কেউ? ছাত ধসে না, ট্যাকশো দিতে হয় না।–ইত্যাদি। (৩)
তা সে থাকগে, কোন্ কথা থেকে কোন্ কথায় চলে এলুম, ওই তো আড্ডার দোষ।
কাইরোর কাফে আমাকে বোঝাচ্ছিল, আমি পাঙটুয়াল, অর্থাৎ কথা দিয়ে থাকি ঘণ্টায় আসব বলে, আর আসি কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ঘণ্টায় অর্থাৎ পাঙট্যুয়ালি… ইত্যাদি।
এর পর কাফে বলে কি না, আমি নাকি অন্-পাঙট্যুয়ালও বটে!
সেটা কী প্রকারের?
টুটেনখামেন-এর আমল থেকে এদেশের অলিখিত আইন, মিটিং যদি ধার্য হয়ে থাকে সাতটায়, তবে শুরু হয় আটটায়, দিল-হামেশাই হচ্ছে। আমি নাকি উপস্থিত হই কাঁটায় কাঁটায় সাতটায়। এটা নাকি অন-পাঙট্রয়াল পাঙট্যুয়ালিটি।
সেটা নাকি স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার একচেটে কারবার। নীলনদে কখনও প্রচুর জল আসার ফলে কাফের সকলে গায়ে রেশমের স্যুট চড়ায়, কখনও মাত্র কঞ্জিনটুকু সম্বল; কখনও সাহারায় ঝড়ের ঠেলায় ছ ফুট বালি জমে বাড়ির দেউড়ি বন্ধ হয়ে যাবে এবং তারই ফলে সর্বাপেক্ষা মারাত্মক পরিস্থিতি–কাফেতে আসার জো-টি নেই–এসবের হদিসান্বেষীরা নাকি পরবর্তীকালে আবহাওয়া দফতরের ডিরেকটার জেনরেল হয়।
ইতিমধ্যে আমাদের টার্ক–(তুর্কি বললে মানুষটাকে ভুদ্র বলে মনে হয়)–ইংরেজি অর্থে। টার্ক, সদস্য তওফিক এসে উপস্থিত।
পয়লা নম্বরের ধুরন্ধর এবং গোঁয়ার। আমাকে শুধোলে, কী বাবাজী, খানিকক্ষণ আগে তোমাকে দেখলুম এক আজব চিড়িয়ার সঙ্গে–ওহেন মাল কস্মিনকালে বাবা, এই বহুতর চিড়িয়ার শহর কাইরোতেও দেখিনি! ব্যাপারটা কী?
আমি বললুম, আর কও কেন? সেই কথাই তো এদের বোঝাতে যাচ্ছিলুম। সমস্ত বৈকেলটা কেটেছে ব্রিটিশ কনসুলেটে-বুনোহাঁস ধরার চেষ্টা কখনও করেছ? তাইতেই হেথায় হাজিরাতে দেরি?
বুনো হাঁস! সে আবার কী?
নয় তো কী? কিন্তু আমার সঙ্গে যে চিড়িয়া দেখেছিলে সে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিজ। আমার দেশের লোক।
কাফে অবাক। সে কী? আমরা তো জানতুম, তুমি কোথাকার সেই বাঙ্গালা না, কী যেন বলে, সেই দেশের একমাত্র লক্ষ্মীছাড়া এসেছ এদেশে।