আড্ডাযজ্ঞের আমরা অভিশপ্ত (পুত, যাই বলুন) ভস্ম। আমরা যেতে পারব না, নীলকণ্ঠের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জটার ভিতর গঙ্গার সন্ধানে।
তিনিই আসতেন। আমি যার প্রতি দু লহমা পূর্বে ইঙ্গিত করেছি তিনিই আসবেন, স্বেচ্ছায় সানন্দে। শ্যামবাজার থেকে শুরু করে আড্ডা মেরে মেরে তিনি হেসেখেলে পৌঁছে যাবেন টালিগঞ্জে। রিপোর্ট যা লিখবেন সে এক অভিনব মেঘদূত! শ্যামবাজার-রামগিরি থেকে টালি-অলকা!
কিন্তু আমরা কমিশনকে বিভ্রান্ত বা প্রেজুডিস করতে চাই নে বলে অত্যধিক বাগবিস্তার থেকে নিরস্ত হচ্ছি। তবে একটি বিষয়ে তাবৎ গৌড়ভুমি যখন বিলক্ষণ সচেতন, সেটি যেন কমিশন বিস্মৃত না হন।
আড়া জীবন্মৃত কি না, যদি হয় তবে তার অমরুতাঞ্জন সঞ্জীবনী সুধা কী, সে নিয়ে তো কমিশন চিন্তা করবেনই যথেষ্ট সুযোগ পাবেন, আজকাল প্রায়ই বিজলি ভ্রষ্টা রমণীর মতো সাঁঝের বেঁকে চোখ মারতে মারতে আঁধারে গায়েব হয়ে যায়, তখন আত্ম-অন্বেষণী, বিশ্বভাবনা ভিন্ন গতি কী?–কিন্তু আমরা আগেভাগেই বলে রাখছি;–
বঙ্গসন্তান চাহে না অর্থ, চাহে না মান, চাহে না জ্ঞান– সে চায় ডিগ্রি!
আড্ডাবাজরূপে সে যদি স্বীকৃতি পায় এবং উমেদার মাত্রেই জানেন–খানদানি আড্ডাতে সিট পাওয়াটাই কী কঠিন কর্ম– তবে সে ডিগ্রি না নিয়ে ছাড়বে না।
এবং ওইসব বস্তাপচা পি-এইচডি, ডিফিল, হনোরিস কাউজা, সুমমা কুম লাউডে, দকত্যোর অ্যাস লেত্র, ফার্জিল-অল-মুহদিসিন, শমশির-ই-জমশিদই আলিমান, সাংখ্যবেদান্ততর্কচুক্ষু– এসব উপাধি-খেতাব-ডিগ্রি বিলকুল না-পাস।
তা হলে সে ডিগ্রির নাম কী হবে?
এ বাবদে ইহসংসারে সর্বাভিজ্ঞ মহাজনকে আমরা চিঠি লিখেছি।
ইনি স্ট্রাসবুরগ শহরের সরকারি উপাধিদাতা।
শহরের সদর দেউড়ি দিয়ে ঢুকলেন এক অশ্বারোহী–ইয়া মোছ, ইয়া তলোয়ার।
সামনেই সদররাস্তা-বুলভার জোড়া একটা টেবিলের পিছনে দাঁড়িয়ে ফ্রক কোট, টপ-হ্যাট, আতশি-কাঁচের চশমা পরা এক স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে- সরকারি কর্মচারী। আমাদের আই এ এস গোছ।
হুঙ্কারিলেন, তিষ্ঠ!
? ? ?
আপনি ডক্টরেট উপাধি ধরেন?
অশ্বারোহী অবতরণ পূর্বক সবিনয় : আজ্ঞে না।
গম্ভীর নিনাদ : এ শহরে ডক্টরেট না থাকলে প্রবেশ নিষেধ।
কাতর রোদন : তা হলে উপায়?
মোলায়েম সান্ত্বনা : উপায় আছে বইকি। এই তো হেথায় টেবিলের উপর রয়েছে সর্ব গোত্রের উপাধিপত্র। আপনার দেশ?
আশাভরা কণ্ঠ :এজ্ঞে, লুকসেমবুরগ।
নুড়ি-চাপা ভিন্ন ভিন্ন ডাই থেকে একখানা করকরে কাগজ তুলে নিয়ে : আ–সুন, আসুন, স্যর (বিতে শ্যোন, প্লিজ!)। দক্ষিণা : পঞ্চাশত্রুদ্রা।
বিগলিত আপ্যায়িত কণ্ঠ : বিলক্ষণ, বিলক্ষণ (ডাংকে শ্যোন, মেনি থ্যাংকস)। এই যে।
অশ্বারোহী নগরকেন্দ্রে প্রবেশ করতে করতে ভাবল, আমার এই অশ্বিনীটি আমার বিস্তর সেবা করেছে। এর জন্য একটা হনোরিস কাউজা ডক্টরেট আনলে মন্দ হয় না। ঘোড়া ঘুরিয়ে উপাধিদাতার কাছে এসে তার সদিচ্ছা জানাল। আই এ এস দুঃখ-ভরা কণ্ঠে বললেন, ভেরি ভেরি সরি, হের ডকটর! এ শহরে ডকটরেট দেওয়া হয় শুধু গাধাদের। ঘোড়ার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেই।
আমরা এরই উপদেশ চেয়ে পাঠিয়েছি। আমেন।
———
১. প্রথম দুটো শব্দ ফরাসি, তৃতীয়টি ইতালীয়। অর্থাৎ রসালাপ করার তত্ত্বটি বরঞ্চ লাতিন জাত কিছুটা জানে। শুনেছি, অ্যাংলো সেশনদের এমন ক্লাবও নাকি আছে যেখানে কোনও মেম্বার কথাটি বলামাত্র তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। একদা একজন মেম্বার নাকি আগুন লাগা মাত্রই আগুন আগুন বলে চেঁচিয়ে ওঠাতে ক্লাববাড়ি রক্ষা পায়। তাকে অনেক ধন্যবাদ জানাবার পর (অবশ্য লিখিতভাবে) খাতা থেকে তার নামটি কিন্তু কেটে দেওয়া হয়।
আড্ডা–পাসপরট
এত দেরিতে যে?
শোনো কথা! আড্ডাতেও আসতে হবে পাঙট্যুয়ালি?
হ্যাঁ, সেই কথাই তো হচ্ছে। তুমি তো হামেশাই পাঙট্যুয়ালি অন-পাঙটুয়াল।
আড্ডা প্রতিষ্ঠানের কাশীবৃন্দাবন কাইরো শহরে। এ সম্বন্ধে আমার গভীর গবেষণামূলক একাধিক গেরেমভারি প্রবন্ধ খানদানি অকসব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাত্মক বনেদি ত্রৈমাসিকে বেরুবার কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎ কর্তাদের খেয়াল গেল যে আমার ওই সাতিশয় উচ্চপর্যায়ের লেখাগুলো যদি একবার তাঁদের কাগজে বেরোয় তবে সে-কাগজের মান বা স্ট্যান্ডারড চড়াকসে এমনই সুপুরিগাছের ডগায় উঠে যাবে যে, আর পাঁচজন লেখক সে মগডালে উঠতে পারবে না। অথচ পয়লা নম্বরি পাঠকমাত্রই আমার উচ্চাঙ্গ লেখায় পেয়ে গেছেন তাজা রক্তের সন্ধান, হয়ে গেছেন ম্যানইটার। সম্পাদকমণ্ডলী তখন আর পাঁচজনের লেখা বাসি মড়া পাচার করবেন কী প্রকারে! একবার ভাবুন তো, স্বয়ং কবিগুরু যদি কোনও সপ্তাহের দেশ পত্রিকায় ট্রামেবাসে, সুনন্দর জারনল এবং পঞ্চতন্ত্র সব কটাই লেখেন, তার পর আমাদের তিনজনের–এককথায় সৈয়দ সুনন্দ করের কী হাল হবে? পচা ডিম ছুড়বে আমাদের মাথায় পাঠকগুষ্টি কাগজ হয়ে যাবে বন্ধ। সম্পাদক, প্রকাশক, মুদ্রাকর, লেখক। সবাইকে বসতে হবে রাস্তায়। আমাদেরও তো কাচ্চাবাচ্চা আছে। ডাল-ভাত যোগাতে হয়।
আমার অত্যুৎকৃষ্ট রচনার মূল্য অকসব্রিজের কর্তৃপক্ষ বুঝুন আর না-ই বুঝুন–এটা কিন্তু ভুললে চলবে না তারা ইংরেজ। ইংরেজ ব্যবসা বোঝে। নেপোলিয়ন একদা বলেছিলেন নেশন অব শপ-কিপারজ–এখন বলা হয় নেশন অব শপ-লিফটারজ(১) (ভদ্রবেশী দোকান-লুটেরা)। ব্যবসা বোঝে বলেই তারা আমার লা-জবাব প্রবন্ধগুলো ইনশিওর করে সবিনয়, সকাতর ফেরত পাঠায়–ছাপালে তারা, তাদের আণ্ডাবাচ্চারা বেবাক-আণ্ডাহীন হবে সেই কারণ দর্শিয়ে।