কিন্তু এ সংবাদখণ্ডটি নিয়ে কিঞ্চিনমাত্র দেমতি ডুয়েল হয়নি। দিল্লির লালাজি, মিয়াসাহেবরা খবরটা পরিবেশন করা সত্ত্বেও ব্যাপারটির গুরুত্ব এহমিয়ৎ সম্বন্ধে বিলকুল বে-খবর। আড্ডা? সো ক্যা বলা? মজলিস, মহফিল, মুশারা, জলসা, বয়েৎ-বাজি– আলবৎ লেকিন আ? সো ক্যা আফৎ, গজব? ওদের আড্ডা ভিন্ন বাথানের গরু– ওদের ভাষায় ভিন্ন ঝোঁপের চিড়িয়া– যেমন ওদের গোলাব জামুন আর আমাদের গোলাপ জাম।
তা সে যাই হোক যাই থাক, খবরটা যদি গুজব বা আফওয়া না হয় (হলে আগের থেকেই কলমে খৎ দিচ্ছি!) তবে বড় দুঃখের সঙ্গে শ্রীযুক্ত ত্রিগুণা স্যানকে তাঁরই দ্যাশ করিমগঞ্জের একটি পদাবলি ঘেঁষা লোকসঙ্গীত স্মরণ করিয়ে দেব :
দেখা হইল না রে, শ্যাম
আমার এই নতুন বয়সের কালে—
রসরাজের স্মরণে শ্রীমতী বলছেন, ঠাকুর! তুমি নির্দয় নও; আমাদের সাক্ষাৎ একদিন না একদিন হবেই হবে। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার এই নতুন (নতুন) বয়সে যে দেখা হল না, সে-ই আমার মর্মবেদনা।
ডাক্তারেতে বলে যখন মরেছে এই লোক
তাহার তরে বৃথাই করা শোক
কিন্তু যখন বলে জীবত
তখন শোনায় তিতো।
খানদানি আড্ডা এখন জীবন্ত। তার নতুন বয়স বহু কাল হল গেছে। এখন আর তার কোন্ গুণ আছে, তিন-গুণী?
আড্ডা সম্বন্ধে আমার যা বক্তব্য সে আমি বহুবার বহু স্থলে নিবেদন করেছি। বহু সিন্ধু পেরিয়ে বহু দেশ ঘুরেছি আড্ডার সন্ধানে পাপমুখে কী করে বলি, গিয়েছিলুম লবুজো কপচাতে; আখেরে সর্বত্র সর্ব পরীক্ষাতে নাগাড়ে ফেল মেরে মেরে বিলক্ষণ বুঝে গেলুম, আমার যদি জ্ঞানগম্যি কখনও হয়–তা সে ঝুটাই হোক আর সাচ্চাই হোক সেটা হবে আড্ডাতে শিক্ষামন্ত্রী যে তত্ত্বটি কনফারম করলেন এই অ্যাদ্দিন পরে … ফের বহু সিন্ধু পেরিয়ে দেশে এসে দেখি, সেই আড্ডার বিন্দুটি খরতাপে বাম্পপ্রায়।
খানদানি আড্ডা যে জীবন্ত সে তথ্য তর্কাতীত। এই যে কলকাতা শহরে ঝাঁকে ঝাঁকে পস্তলা-দস্তলা হামেহাল উঠছে তো উঠছেই এর কটাতে রক থাকে, বৈঠকখানা আছে? রক উঠেছেন ডাক-এ, আর বৈঠকখানার বদলে ড্রয়িংরুম। এদিকে ক্ষুদে একটি পেগটেবিলের উপর অতি পাতলা ডিমের খোলস-পরা পরসেলেনের প্লেটে স্ন্যাক, অন্যদিকে ফঙ্গবেনে টিপয়ের উপর বেলজিয়াম কাঁচের ঢাউস ফ্লাওয়ার ভাজ। সোফাতে আরামসে হেলানও দিতে পারবেন না, পাছে মাথার তেল লেগে সোফাভরণ চিটচিটে হয়ে যায়। বত্রিশটি দাঁতের মধ্যিখানে বেচারি জিভকে যেরকম অতিশয় সন্তর্পণে হাফিজ, খবরদার হয়ে নড়াচড়া করতে হয়, আপনাকেও করতে হবে তাই। তবে সান্ত্বনা, ভুগন্তি বাড়ির মালিকেরই সবচেয়ে বেশি। পাছে মহামূল্যবান কোনও জোড়াবাধা বস্তুর একটি ভেঙে যায়! বিলিতি মাল– এখন আর বাজারে পাওয়া যায় না।
গালগল্প যে একেবারেই হয় না, সেকথা বলা যায় না। তাকে সোয়ারে, মাতিনে (ম্যাটিনি) কনভেরজাৎসিয়োনে(১) যা খুশি নাম দিতে পারেন, এমনকি আজকের দিনের ভাষায় সেমিনার বললেও দোষ নেই কিন্তু একে আড্ডা নাম দিলে আমাদের নকিষ্যি কুলীন আড্ডার মেম্বরগণ একবাক্যে বলবেন, কঁহা আসমানকা তারা, আর কঁহা পিঠকা (আসলে ভদ্রসমাজে মূল শব্দটা অচল) পাঁচড়া!
গঙ্গাস্নান কমে যাচ্ছে কেন? পুণ্যবানরা নতুন নতুন ঘাট বানাচ্ছেন না তাই।
আড্ডা কমে গেল কেন? মডার্নরা রক বানান না বলে। পাল্লায় পড়ে কেউ কেউ-বা প্রাচীন দিনের অগোছালো বৈঠকখানাকে ড্রয়িংরুমের সাত চাপের কারবন কপি বানাচ্ছেন—- দিল্লিতে বলে বুড়ো ঘোড়ার গোলাপি ন্যাজ কিংবা বুড়ি দাদিমার হাতে বাহারে মেহদি।
কিন্তু এহ নিরতিশয় বাহ্য।
গুহ্য সমস্যা অপিচ সরলতম প্রশ্ন : এই যে আমাদের মন্ত্রীবর তরুণদের আড্ডাবাজ করে তুলবেন বলে যমুনা পুলিনে দাশরথির শপথ গ্রহণ করলেন সেটা কি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে কিংবা প্রকৃত আড্ডাবাজের ন্যায় ধ্যত্তর ত্তোর অগ্রপশ্চাৎ হুঙ্কার ছেড়ে?
ঝাড়া আঠারোটি দিন আমাদের আড্ডাটি এই নিয়ে কুস্তি করেছে। নানা প্রশ্ন, বহুবিধ সপলিমেনটরি, ততোধিক এফিডেভিট– সর্বশেষে এন্তের বুলু পিরিন্ট (আমাদের মন্ত্রীমশাই এ বস্তুটি বিলক্ষণ চেনেন ভাই ভাই তৈরি হল, অবশ্য আড্ডাধারী মাত্রই জানেন, আমাদের হাইজাম্প লঙ-জাম্প মুখে মুখে।
প্রতি প্রস্তাবের বিরুদ্ধেই পাল্টা প্রস্তাব উঠেছিল; তবে একটি বিষয়ে সকলেই একমত হয়েছেন।
যদ্যপি মন্ত্রী মহাশয় এলেমদার ব্যক্তি তথাপি এ-হেন কঠিন গুরুভার তিনি যেন ভিক্ষুণীর অধম সুপ্রিয়ার মতো এজমালি বা বারো-ইয়ারি পদ্ধতিতে উত্তোলন করেন। বিগলিতার্থ; — তিনি যেন।
১। একটি কমিশন নিয়োগ করেন।
এস্থলে আমার অতিশয় গোপনীয় একটি অভিজ্ঞতা থেকে জানাই, হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত জজকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অন্তরঙ্গরূপে চিনি, যিনি একবার একটি আড্ডাবাজ ছোকরাকে অধ্যাপক পদের জন্য সুপারিশ করে জনৈক ভাইস-চ্যানসেলারের কাছে হুট হয়েছিলেন। ভি সি যখন জিভ কেটে বললেন, ছোকরা পাড় আড্ডাবাজ তখন তিনি জরডন জলে ধোয়া তুলসিপাতা-পানা মুখ করে নাইফ উত্তর দিয়েছিলেন ওই তো তার আসল এলেম।
একে কমিশনের চ্যারম্যান করতে পারলে সর্বরক্ষা– সকলং হস্ততলং!
২। ইতোমধ্যে দেখা গেল আরেকটি বিষয়ে আমাদের দশদিশি শিরদ্বন্দ্বী প্রকৃত আদ্যপ্রাণ ব্যক্তিকে কাটা ফালাইলেও সে কোনও কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে যেতে পারবে না। হরহামেশা হাজামৎ করছি আমরা উইলসন জনসনের, আর আমরা যাব কমিশনের সম্মুখে!