কী নিয়ে ঝগড়া, মসিয়য়া? জান কী নিয়ে–ঘুড়ি নিয়ে? তা হলেও তো বাঁচতুম। সে তো হর-হামেশাই হচ্ছে। এ ঝগড়া সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস নিয়ে। বলি :
ওই সময় অর্থাৎ তখনও যুদ্ধ শেষ হয়নি, অবশ্য হিটলারের পরাজয় সম্বন্ধে তখন সবাই নিঃসন্দেহ– এক ফরাসি লেখক লিখেছেন, এই যে আমরা, ফরাসিরা পাত্রি(স্বদেশ), পাত্রি, লিবেরতে লিবেরতে বলে চেঁচাই তার মূল্য কতটুকু? তিনি নাকি, তার পর লিখেছেন, ফরাসি চাষা যদি তার গম দু পয়সা বেশি দামে বিক্রি করতে পারে তবে সে থোড়াই পরোয়া করে দেকার্ত আপন জাতভাই ফরাসি না দুশমন জরমন।
এই নিয়ে লেগেছে তুলকালাম ঝগড়া! এক লেখক বলছেন, যারা ফরাসি জাতের দেশপ্রেম নিয়ে এরকম বিদ্রূপ করে তাদের ফাঁসি হওয়া উচিত। অন্য লেখক বলছেন, কথাটা টক হলেও হক। এবং যে ফরাসি লেখক একথা বলেছেন তিনি তো জর্মন বা তাদের দোস্ত পেতাঁর সহযোগিতা করতে রাজি হননি। তাঁর সততা সম্বন্ধে যারা সন্দেহ করে তাদের হওয়া উচিত ফাঁসি। তখন প্রথম জন বললেন, আজ যদি আমাদের ক্লেমাসে বেঁচে থাকতেন তবে ওই যে ব্যাটা ফরাসির দেশপ্রেম নিয়ে মশকরা করেছে তাকে তার নোংরা বন্দুকটা দিয়ে পরিষ্কারটা দিয়ে নয়, যেটা দিয়ে তিনি বুনো শূয়ার মারেন– গুলি করে মারতেন।
এতক্ষণ মালিক ভায়া যে গম্ভীর সুরে কথা বলছিলেন, তার থেকে আমার মনে হচ্ছিল যেন স্বয়ং ক্রেমাসেই লিগ অব নেশনসে প্রতিবেদন পাঠ করছেন।
এবারে হঠাৎ হেসে উঠে বলল, তার পর যা হল, মসিয়য়া, সে সত্যি যাকে বলে কু দ্য তেয়াৎর(৩)-নাটকীয় ব্যাপার–ইতোমধ্যেই যে আমাদের পাদ্রি সাহেব কখন এখানে এসে এক কোণে দাঁড়িয়ে এঁদের তর্কাতর্কি শুনছিলেন সেটা আমি লক্ষই করিনি।
তিনি এগিয়ে গিয়ে বললেন, মেসিয়ো, আমি আপনাদের দোজ করতে চাই নে; সামান্য একটি বিষয়ের উল্লেখ করে আপন পথে চলে যাব। আপনারা শহুরে সজ্জন শুনেছি, আপনারা বঁ দিয়োর (ভগবানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। আমার শুধু বক্তব্য, আপনাদের একজন বলছিলেন, আজ ক্লেমাসে বেঁচে থাকলে তিনি নাকি কাকে যেন গুলি করে মারতেন। এ-ভভাওয়ালা, মেসিয়ো– আজই সন্ধ্যায় এই কাগজখানা আমার কাছে এসেছে আমাদের কলোনি ট্যুনিস থেকে। তাতে প্রকাশিত হয়েছে একখানি চিঠি। ইটি লিখেছেন মসিয়ো ক্রেমাসের ভ্রাতুস্পুত্রী তার বয়স, এখন চুরাশি। তিনি লিখেছেন–শের মসিয়ো জিদ, আমি আমার জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে বহু বছর বাস করেছি। আমি বলতে পারি, আজ তিনি বেঁচে থাকলে আপনার পক্ষ নিতেন। তাঁকে কতবার বলতে শুনেছি, জমি! জমি!! শুধু জমি!! আর টাকা। ব্যস, মাত্র এ দুটো বই আমাদের চাষিরা চেনে!
পাদ্রি সায়েব বললেন, তা সে যাক! কিন্তু এটা কী বঁ দিয়োর মিরাকল নয় যে, আজই আমি এ কাগজখানা পাব, আজই আপনারা এ আলোচনা তুলবেন, আজই আমি সেই পত্রিকাটি পকেটে করে আজই এখানে আসব এবং আপনাদের দ্বন্দ্বের সমাধান করে দেব!…ও রভোয়া মসিয়ো! কাল রোববার গির্জেয় দেখা হবে।
কাহিনীটি শেষ করে মালিক মিটমিটিয়ে হেসে বলল, এই যে বিরাট ফ্রান্সভূমি– এদেশের কারও বিশ্বাস, প্রভাঁসের লোক বড় সরল, বিশ্বাসী, ধর্মপ্রাণ আর কারও-বা বিশ্বাস তারা কুসংস্কার কুণ্ডে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।… আপনার কী মনে হয়? আপনি তো এসেছেন ধর্মের দেশ LInde থেকে।
আমি তার মিটমিটে হাসি থেকে তারই বিশ্বাস কোন দিকে বুঝতে পারলুম না।(৪)
———–
১. প্রভাঁসের বকরি সম্বন্ধে লিখেছেন দোদে– Le Chevre de M. Seguin.
২. এ-ও পাঠক পাবেন পুস্তকে।
৩. Coup detat, cout de palais তুলনীয়। আজকাল পৃথিবীর সর্বত্র নানারকম কু (অনেক সময়ই কিন্তু সেগুলো শিব্রামীয় সু!) হচ্ছে বলে এটা উল্লেখ করলুম।
৪. আঁদ্রে জি-এর ডাইরি, Journal 1939-42, 1942-42, Appendice, 200ff.
আড্ডা
কী বললেন স্যার? বাড়ি বিক্রি করতে এসেছেন? আমি কিনব? আমি! বাড়ি নিয়ে করবটা কী আমি? জন্ম নিলুম হাসপাতালে, পড়াশুনো করলুম হস্টেলে, প্রেম করেছি ট্যাক্সিতে, বিয়ে হল রেজিস্টারের আপিসে। খাই ক্যানটিনে–কিংবা যারে কয় ভোজনং যত্রতত্র–সকালটা কাটে কর্তাদের তেলাতে, তেনাদের তরে বাজার করে দিতে…হাটে-র্যাশনে, দুপুরটা আপিসে, মাঝে মিশেলে সিনেমা হলে সন্ধেটা। পটল তুললে শুইয়ে দেবে নিমতলায়। বাড়ি নিয়ে কি আমি গুলে খাব? তার চেয়ে বলি, আসলে আমার দরকার একটি আড্ডার। একটি অত্যুকৃষ্ণ আড্ডার। তার খবর দিতে পারেন? তবে বুঝব, আপনি একটি তালেবর ব্যক্তি!
কথাটা ন সিকে খাঁটি। অত্যুকৃষ্ণ কৃষ্ণ যদি কিষ্ট বা কেষ্ট হয় তবে উৎকৃষ্ণ-ই-বা হবে না কেন?) আড়া প্রতিষ্ঠানটি হালফিল পুরো-হাতা ব্লাউজের মতো ডাইইং ইনডাস্টরি–মৃতপ্রায়।
এহেন অবস্থায় অকস্মাৎ বিনা মেঘে পুষ্পঘাত! দিল্লি থেকে খবর এসেছে সদ্যভূমিষ্ঠ শিক্ষামন্ত্রী প্রতিজ্ঞা করেছেন, বাঙালিকে তিনি আড্ডাবাজ করে ছাড়বেন!
দিল্লি থেকে আসা খবরের সঙ্গে আমি প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ি না– বয়স হয়েছে। খবরটা ফলাও করে প্রকাশিত হবে, সঙ্গে সঙ্গে দেমাতি (dement) বেরুবে, ফের তস্য দেমাতি বেরুবে দলিলপত্রসহ, চোপরা-ভাটিয়া আফটার এডিট লিখবেন, পারলিমেনটে গোটা তিনেক মন্ত্রী নাকুনি-চুবুনি খাবেন, ওই নিয়ে খানদানি খানদানি আয় (আমাদের যৌবনে) তর্কাতর্কির ফলে গোটা তিনেক পেয়ারে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হবে– তবে আমি ব্যাপারটার মোটামুটি আবছা-আবছা ধুয়াশাপারা একটা উমান্ (অনুমান নয়, তার আউটলাইন বড় ধারালো) করে নিই যে, ব্যাপারটা কী হয়ে থাকতে পারে। গোলনদাজদের কায়দা-করিনা নাকি এই দস্তুরেই হয়। প্রথম বোমা তাগ করবে লক্ষ্যবস্তু থেকে দূরে, পরেরটা কাছে, তার পর দুটোতে যোগ দিয়ে হাফাহাফি করে মোক্ষম মধ্যিখানে।