৩. এস্থলে বক্ষ্যমাণ রচনাটি যদি আমাকে কপালের গর্দিশবশত ইংরেজিতে লিখতে হত তবে পরানভয়ে হরিণের ছোটাটা হুবহু ফরাসি ইডিয়মে লিখতুম–Ventre a terre– অর্থাৎ with belly to ground; এমনি সামনের দিকে ঝুঁকে প্রাণপণ ছুটছে যে মনে হয় মানুষটার পেটটা বুঝি মাটি ছুঁয়ে ফেলেছে! (ফরাসি শব্দতাত্ত্বিকদের জন্য ভাত্র ভেনট্রিলোকুইস, পেট থেকে যে কথা বের করে; তের টেনেট্রিয়াল = পার্থিব তুলনীয়)
আঁদ্রে জিদ
দুনিয়ার লোক হদ্দমুদ্দ হয়ে প্যারিস যায়, এবং প্যারিসের ধনীদরিদ্র সকলেরই কামনা, কী করে গ্রামাঞ্চলে একখানা কুটিরাবাস নির্মাণ করা যায়। প্যারিসের ফ্ল্যাটখানাও থাকবে এবং সেখানে মাঝে-মধ্যে আসবেন থিয়েটার অপেরা দেখবার জন্য, বন্ধুজনের (বান্ধবী তো নিশ্চয়ই) সঙ্গে মিলিত হবার জন্য।
খাঁটি স্ট্যাটিস্টিক্স দেওয়া কঠিন– বক্তিগতভাবে বলতে পারি, যে ক-জন মহৎ ফরাসি লেখক আমার প্রিয় তাদের প্রায় সকলেই জীবনের অধিকাংশ ভাগ কাটিয়েছেন মফস্বলে। যারা নিতান্তই কোনও না কোনও কারণে পেরে ওঠেননি– যেমন আলফাস দোদে– তাঁরা সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন গ্রামাঞ্চলে, কোনও সখার বাড়িতে।
প্রভাঁসের যে জায়গাটিতে দোদে বারবার গেছেন সেখানে দিন পাঁচেক কাটানোর পর এক অপরা বসে আছি, যে ইটিতে উঠেছিলুম (এসব ই এমনই গাইয়া যে এগুলো না হোটেল, না ডাক-বাঙলো, না সরাই, না চটি– সবকটিরই অল্প-বিস্তর সুবিধে-অসুবিধে দুই-ই এগুলোতে পাবেন। তারই জানালার কাছে বাইরের দিকে তাকিয়ে। ঢেউখেলানো উঁচু-নিচুর টক্করে ভর্তি জনপদ ধরিত্রীর দূরত্ব যেন আরও বাড়িয়ে দেয় আপন দৃষ্টি যে কত দূরান্তে যেতে পারে সে সম্বন্ধে মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং আশ্চর্য, সমুদ্র যদ্যপি দিগন্ত বিস্তৃত তার পারে বসে মানুষের এ অভিজ্ঞতা হয় না।
ইনকিপার, পত্র (Patron), মালিক– যে নামে খুশি ডাকুন–কাছে এসে দাঁড়াতেই আমি প্রসন্ন বদনে বললুম এ বাঁ, আল– এ শব্দগুলোর মানে অভিধানে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই, যেমন এই যে, হেঁ হেঁ বেশ বেশ– শব্দগুলো নিশ্চয়ই কোনও না কোনও মানে ধরে কিন্তু আসলে এগুলো ফারসি ভাষাতে যাকে বলে তাকিয়া-ই-কালাস অর্থাৎ কথার তাকিয়া অর্থাৎ যার উপর ভর করে কথাবার্তা আরাম পায়– জমে ওঠে।
তার পর বললুম, বসবে না? একটা কিছু খাও।
বলল, এ বাঁ, আমি আপনাকে দেরাজ (ডিসএরেঞ্জ শব্দার্থে অর্থাৎ ডিসটার্ব বা বদার) করছি না তো?
আমি প্রসন্নতর বদনে বললন, পা দ্য তু– বিলকুল না!
বলল, মসিয়ো, আমি আদৌ নোজি না। বিশেষত যখন দেখতে পাচ্ছি, আপনি যখন আপন মনে, মনের সুখে আছেন। ও লা লা–কাল সন্ধ্যায় আমাদের আড্ডাটি যা জমেছিল। আর আপনি যা হাসাতে পারেন
একদম গুল। হাসাতে পারার মতো তেমন কোনও স্টা আমার নেই। আসলে ব্যাপারখানা হয়েছিল এই যে, আমাদের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত কতকগুলি গল্প, গোপালভাড় ইত্যাদি আমি তাদের শুনিয়েছিলুম আপন ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে। তাদের কাছে লেগেছে এপাতা (ভয়ঙ্কর মজাদার) এবং অরিজিনাল। অবশ্য এসব গল্প যখন প্যারিস-লন্ডনেই পৌঁছয়নি তখন প্রভাঁসের পা-বর্জিত অজপাড়াগায়ে যে অরিজিনাল মনে হবে তাতে আর বিচিত্র কী? গোপালের দু-একটি রিসৃকে (risky আদিরসাত্মক) গল্প বলতেও ছাড়িনি, এবং তখন গাঁয়ের পাদ্রি সাহেবই এবং তিনিই ছিলেন আসরের চক্রবর্তী সবচেয়ে বেশি চোখের ঠার মেরে আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন।
বললেন, মসিয়ো, আমাদের গ্রামে কজন বিদেশি এসেছে সে আমি এক আঙুলে বলতে পারি- তা-ও তারা পাশের দেশ স্পেন বা ইতালির বাউণ্ডুলে– আর আপনি তো এসেছেন কোথায় সেই সুদূর লাদ (L Inde) থেকে। এখানে আপনি কী মধু পেলেন, বলুন তো!
আমি বললুম, তুমি তো বলেছিলে, তুমি কখনও প্যারিস ত দেখোনি। তোমাকে বোঝানো হবে শক্ত। তবে সংক্ষেপে বলতে পারি, এটা অনেকটা রুচির কথা। আপন দেশেও আমি গ্রামাঞ্চলে বেড়াতে, বাস করতে ভালোবাসি। তা ছাড়া এটা কবি মিসালের দেশ।… আচ্ছা, অন্য লোক আসে না এখানে মিসত্রালের জন্মভূমি দেখতে?
বেশ গর্বভরে বলল, নিশ্চয়ই, মসিয়য়া, তবে তারা সবাই ফরাসি–
তার পর কী যেন মনে পড়ে যাওয়াতে হঠাৎ থেমে গিয়ে এবারে সে উৎসাহভরে বলল, ও লা লা। সে এক কাণ্ড!
দুই লেখকের লড়াই। সে হল গিয়ে ১৯৪৪-এর শেষের দিকের কথা। মার্কিনিংরেজ নরমাদিতে নেমে প্রায় সমস্ত ফ্রান্স দখল করে ফেলেছে, ওই সময় কী কারণে, কী করে যেন দুই লেখক–হ্যাঁ খাঁটি ফরাসি–এসে উঠেছেন আমার এখানে। আর এই ঘরেই, আমরা কাল যেখানে দুপুররাত অবধি কত আনন্দে হইহুল্লোড় করলুম, এসে বসেছেন, সেই দুই লেখক; কিন্তু তাঁরা তাঁদের চতুর্দিকে যে আবহাওয়া নির্মাণ করলেন সেটি ঠিক তার উল্টো। অ্যাব্বড়া বড়া গেরেমভারি হাঁড়িপানা গম্ভীর একজোড়া মুখ দেখে আমার গাইয়া খদ্দেররা তো আশ্রয় নিল ঘরের অন্য কোণে।
ওঁরা গুরুগম্ভীর আলোচনা করে যাচ্ছেন নিজেদের ভিতর– আমরা ওদিকে কান দিইনি। কিছুক্ষণ পরে তাদের গলা চড়তে লাগল, তার পর আরম্ভ হল রীতিমতো ঝগড়া। তার পর আরম্ভ হল আমাদের ওই পাহাড়ি বকরিতে করিতে যেরকম লড়াই হয়।(১) তার পর বলদে বলদে। অবশ্য আমাদের বলদ প্রতিবেশী স্প্যানিশদের বলদের তুলনায় তেমন কিছু না।(২)