পক্ষান্তরে দেখুন, জলপাইগুড়ি থেকে বেরিয়ে অন্ধ খঞ্জ শ্রীধামে পৌঁছয় না, কেদার-বদরির পুণ্যসঞ্চয় করে না! ভারতীয় কত কালা বোবা কপর্দকহীন প্রতি বছর মক্কায় গিয়ে হজ করে! রাখে আল্লা, মারে কে!
চলে যাবে, প্যারিসে ইংরেজি জানা না থাকলেও চলে যাবে, জানা থাকলে অল্পস্বল্প সুবিধে হতে পারে। লন্ডনে যদি শতেকে একজন লোক ফরাসি বলে, তবে দ্বিতীয় যুদ্ধের পূর্বে প্যারিসের রাস্তায় হাজারে একজন ইংরেজি বলত কি না সন্দেহ। তাই আঁদ্রে মোরোয়া যিনি এই হালে গত হলেন, বা ল্যগুই কাজাৰ্মা ফ্রান্স দেশের আজব চিড়িয়া। প্যারিসবাসী তাজ্জব মেনে শুধোবে ওরা ইংরেজি শিখেছিল! কী করতে মরতে?
জরমনিতে অবশ্য আপনার ইংরেজিজ্ঞান একটু বেশি কাজে লাগবে। যদ্যপি ওই দেশ ইংরেজের প্রতিবেশী নয়। তার অনেকগুলো কারণ আছে। তার একটা কারণ আমাদের মূল বক্তব্যের সঙ্গে বিজড়িত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জরমনির আপন ভূমির উপর কোনও সগ্রাম হয়নি, অর্থাৎ কোনও বিদেশি সৈন্য সেখানে পদার্পণ করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারকিনিংরেজ লড়াই করতে করতে, কদম কদম এগোতে এগোতে জরমনির এক বৃহদংশ দখল করে সেখানে থানা গাড়ে এবং কয়েক বছর সেখানে বাস করে। গোড়ার দিকের মারকিনিংরেজ চালিত মিলিটারি শাসনকর্তাদের ভাষা তখন যে অতি সামান্যও বলতে পেরেছে সে-ই রেশন সহজে পেয়েছে, ফালতো রুটিটা-আণ্ডাটাও তার কপালে নেচেছে। আমার এক জরমন সতীর্থ ধরা পড়ে মারকিন দল জরমন সীমান্তে প্রবেশ করা মাত্রই। ইংরেজি বলাতে তার ভালো অভ্যাস ছিল বলে (তার জন্য আমি স্বয়ং কিছুটা দায়ী। আমাদের পরিচয়ের গোড়ার দিকে আমি জরমন জানতুম না বলে সে তার টুটিফুটি ইংরেজি চালিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে আমার জরমন খানিকটে সড়গড় হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে পুরনো অভ্যাস ছাড়েনি) মারকিনরা তাকে পত্রপাঠ দোভাষীর শব্দার্থে নোকরি দিয়ে দেয়। ফলে তার বাচ্চাদের দুধের অভাব হয়নি, বৃদ্ধা রুগ্ণ শাশুড়ির ওষুধপত্রের অভাব হয়নি। আর সে ভসভস করে অষ্টপ্রহর হাভানা সিগার ফুকেছে যা ইতোপূর্বে তার জীবনে কখনও জোটেনি। মার্কিন সৈন্য চলে যাওয়ার পর মনোদুঃখে সে ধূমপান সম্পূর্ণ ত্যাগ করেছে। আমি তার জন্য গেল বারে বিড়ি নিয়ে গিয়েছিলুম। তার পুনরপি সেই মনস্তাপ। তবে আমি মাঝে-মধ্যে এখনও তাকে দু-পাঁচ বান্ডিল পাঠাই। ভয়ে বেশি পাঠাতে পারিনে– জরমন কসটস আমাদের চেয়ে কম যান না।
১৯৪৪ থেকে জরমনির যা দুর্দিন গেছে বিশ্বের অর্বাচীন ইতিহাসে সেটা উল্লেখযোগ্য। মারকিনিংরেজ সেখানে থানা গাড়ার পর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কাকে না রেশনের সন্ধানে ছুটতে হয়েছে ওদের পিছনে? সবাই পড়িমরি হয়ে তখন শিখেছে ইংরেজি। কবে কোন ঠাকুদ্দা একবার বেখেয়ালে একখানা গাইডবুক টু ইংলিশ কিনেছিলেন, এ আমলে ঠাকুন্দা তারই গা থেকে সন্তর্পণে ধূলি ঝেড়ে এক-পরকলাঙলা চশমা নাকে চড়িয়ে লেগে গেলেন ইংরেজি অধ্যয়নে– ছাপাখানা আবার কবে বসবে, চশমার দোকান কবে খুলবে কে জানে?
এর পর আর কী আশ্চর্য যে প্রথম স্কুল ফের খোলামাত্রই আণ্ডাবাচ্চারা ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করল, তার তুলনায় আমাদের ঊনবিংশ সালের ইংরেজি শেখার প্রচেষ্টা ধূলির ধূলি।
একমাত্র পরাধীনতাই মানুষকে মাতৃভাষা ভিন্ন দ্বিতীয় ভাষা শেখায়। চোখের জলে নাকের জলে শেখায়।
এই পরাধীনতার পিঠ পিঠ আসে আর্থিক পরাধীনতা। আজ জগৎজোড়া মারকিনি ডলারের গরমাই। ইংরেজের তম্বি কমেছে, কিন্তু তিনিও আছেন। উভয়ের ভাষা মোটামুটি একই–ইংরেজি।
তাই আমরা আজ কল্পনাও করতে পারিনে ইংরেজি না শিখে গুষ্টিসুদ্ধ দোভাষী না হয়ে আমাদের চলবে কী করে?
একথা খুবই সত্য, ইংরেজি নিরঙ্কুশ বর্জন করা অনুচিত।
কিন্তু দুনিয়াসুদ্ধ লোককে ঘাড়ে ধরে দোভাষী বানিয়ে সে সমস্যার সমাধান নয়।
———–
১. গোপখেজুরের গল্পটি প্রাচীন ক্ল্যাসিক পর্যায়ের : খেজুরগাছতলায় একটা লোক শুয়েছিল। একটা খেজুর কপালে পড়ে গড়াতে গড়াতে তার গোঁপে এসে ঠেকল। কিন্তু লোকটা এমনই হাড়-আলসে যে জিভ দিয়ে সেটা টেনে নিয়ে মুখে না পুরে অপেক্ষা করতে লাগল। দিনশেষে পদধ্বনি শুনে বিড়বিড় করে বলল, দাদা, এদিকে একটু ঘুরে যাবার সময় যদি দয়া করে তোমার পা দিয়ে ওই খেজুরটা আমার মুখের ভিতর ঠেলে দাও! থ্যাঙ্কয়ু!
২. আইন ব্যবসায়ীদের মতো রক্ষণশীল প্রাণী ত্রিলোকে দুর্লভ। ইংরেজি অবহেলিত বা বিতাড়িত হলে এই বেহেশতি ভারতভূমি যে কোন দোজখে পরিণত হবে তারই কল্পনায় অধুনা শ্ৰীযুত ছাগলা [ওটা ছাগলাই, স্যর, চাগলা নয়। পরপর পুত্রসন্তান মারা গেলে যেরকম আমরা এককড়ি ফকির নফর নাম রাখি গুজরাতিরা তেমনি ছাগলা (ছাগল), মাকড় (পিঁপড়ে, ক্রিকেটার), ঝিড়া (জিন্না, ছোট) রাখে] করুণ আর্তনাদ করে বলেছেন : এই একশো বছর ধরে আইন ব্যবসা যে (পর্বতপ্রমাণ) আইনের কেতাবপত্র ইংরেজিতে রচনা করেছেন সেটা লোপ পাবে, তার ব্যবহার থেকে ভারতবাসী বঞ্চিত হবে। এর ওপর দীর্ঘ মন্তব্য না করে শুধু বলব, এদেশ থেকে ইংরেজিকে নিরঙ্কুশ বিতাড়িত করার জন্য এই একটি মোক্ষম যুক্তি পাওয়া গেল বটে! এবং ছাগলা সম্প্রদায়কে সবিনয় প্রশ্ন : তবে কি প্রলয়াবধি এদেশে আইনের বাহন ইংরেজিই থাকবে? কারণ যত দিন যাবে, পর্বত যে পর্বততর হতে থাকবে! মায়া যে মায়াতর মায়াতম হতে থাকবে! অবশ্য আমি ইংরেজি বিতাড়নের জন্য হন্যে হয়ে উঠিনি, একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী সম্প্রদায়ের মতো।