লক্ষ্য করলুম, কোনো মুসলমান রমণী খবরের কাগজে এ বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না।
তাই প্রশ্ন, লগ্নচ্ছেদ করার জন্য মুসলমান পুরুষ রমণীর কতটুকু অধিকার? এ আলোচনায় মুসলমানদের কিছুটা লাভ হবে, হিন্দুদের কোনো ক্ষতি হবে না।
মৌলা বখশ মিঞা যে-কোনো মুহূর্তে বেগম মৌলাকে তিনবার ‘তালাক, তালাক, তালাক’ বললেই তালাক হয়ে গোল—স্বয়ং শিবেরও সাধ্য নেই তিনি তখন সে তালাক ঠেকান, এস্থলে ‘শিব’ বলতে অবশ্য মোল্লা-মৌলাবী বোঝায়।
বেগম মৌলা সতীসাধ্বী। আজীবন স্বামীর সেবা করেছেন। তার তিনটি পুত্রকন্যা, সবচেয়ে ছোটটির বয়স দশ কিংবা বারো। তার বাপের বাড়িতে কেউ নেই। তিনি বিগত যৌবনা–বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ তিনি পুনরায় বিয়ে করতে চাইলেও নূতন বর পাবেন না।
বেগম মৌলাকে তদণ্ডেই পতিগৃহ ত্যাগ করতে হবে। কাচ্চাব্বাচ্চাদের উপরও তাঁর কোনো অধিকার নেই–নিতান্ত দুগ্ধপোষ্য হলে অবশ্য আলাদা কথা।
‘তালাক, তালাক, তালাক’ বলার জন্য মৌলা সাহেবকে কোনো কারণ দর্শাতে হবে না, কেন তিনি গৃহিণীকে বর্জন করছেন; তার কোন অপরাধ আছে কি না, তিনি অসতী কিংবা চিরক্কাগ্রা, কিংবা বদ্ধ উন্মাদ-এর কোনো কারণই দেখাবার জন্য কেউ তাকে বাধ্য করতে পারে না। এস্থলে নিরঙ্কুশ, চৌকাশ কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’।
(জানি, মৌলা সাহেব হেড আপিসের বড়বাবুর মতো বড় শান্ত স্বভাব ধরেন। হঠাৎ তিনি ক্ষেপে গিয়ে এরকম ধারা কিছু একটা করবেন না, কিন্তু সেকথা অবান্তর। এখানে প্রশ্ন, মৌলার হক কতটুকু, বেগম মৌলারই বা কতটুকু? তুলনা দিয়ে বলতে পারি, ভদ্র হিন্দু সচরাচর বিনা কুসুরে একমাত্র পুত্রকে ত্যাজ্য পুত্র করে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন না। কিন্তু কস্মিনকালেও করেন না একথা বললে সত্যের অপলাপ হয়।)
যাঁরা তালাক আইনের কোনো পরিবর্তন চান না তারা উত্তরে বলবেন, আরো বাপু, তালাক দেওয়া কি এতই সোজা কর্ম? ‘মহরে’র কথাটি কি বেবাক ভুলে গেলে? মৌলার মাইনে তিন শ টাকা। ‘মহরের টাকা পাঁচ হাজার। অত টকা পাবে কোথায় মৌলা সাহেব?
হিন্দু পাঠককে এই বেলা ‘মহর’ জিনিসটি কি সেটি বুঝিয়ে বলতে হয়। ‘মহর’ অর্থ মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে স্ত্রীধন। বিয়ের সময় মৌলাকে প্রতিজ্ঞা করতে হয়, তার বেগমকে তিনি কতটা স্ত্রীধন দেবেন। মৌলা বলেছিলেন, পাঁচ হাজার (অবস্থাভেদে পঞ্চাশ একশ, এক হাজার বা পাঁচ লক্ষ্যও হতে পারে) এবং এ প্রতিজ্ঞাও করেছিলেন, বেগম সাহেবা যে-কোনো মুহূর্তেও স্ত্রীধন তলব করলে তিনি তদ্দণ্ডেই নগদা-নগদি আড়াই হাজার ঢেলে দেবেন এবং বাকী আড়াই হাজার কিস্তিবন্দিতে শোধ দেবেন।
এসব শুধু মুখের কথা নয়। এ সমস্ত জিনিস বিয়ের রাতে দলিল লিখে তৈরি করা হয় ও পরে ‘মেরেজ রেজিস্ট্রারে’র আপিসে পাকাপোক্ত রেজিস্ট্রি করা হয়। মৌলা এ টাকাটা ফাঁকি দিতে পারবেন না, সে কথা সুনিশ্চিত।
উত্তরে নিবেদন :
মৌলার গাঁঠে পাঁচ হাজার টাকা থাক। আর নাই থাক, তিনি যে স্ত্রীকে তালাক দিলেন, সেটা কিন্তু অসিদ্ধ নয়। টাকা না দিতে পারার জন্য শেষ তক মৌলার সিভিল জেল হতে পারে, কিন্তু তালাক তালাকই থেকে গেল। অর্থাৎ একথা কেউ মৌলাকে বলতে পারবে না, তোমার যখন পাঁচ হাজার টাকা রেস্ত নেই, তাই তালাক বাতিল, বেগম মৌলা তোমার স্ত্রী এবং স্ত্রীর অধিকার তিনি উপভোগ করবেন।
মোদ্দা কথা, তালাক হয়ে গেল, টাকা থাক। আর নাই থাক।
***
পুনরায় নিবেদন করি, শাস্ত্ৰ কি বলেন সে-কথা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। কুরানশরীফ যা বলেছেন, তার যেসব টীকা-টিপ্পানী লেখা হয়েছে, তার উপর যে বিরাট শাস্ত্র গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে দেশাচার-লোকচার মিলে গিয়ে উপস্থিত যে পরিস্থিতি বিদ্যমান। তাই নিয়ে আমাদের আলোচনা। সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী বিবাহিত স্ত্রী-পুরুষে একে অন্যের উপর কতখানি অধিকার, বিশেষ করে একে অন্যকে বর্জন করার অধিকার করার কতটুকু সেই নিয়ে আলোচনা ।
পূর্বেই নিবেদন করেছি। স্বামী যে কোনো মুহূর্তে স্ত্রীকে বর্জন করতে পারেন। তাকে তখন কোনো কারণ কিংবা অজুহাত দর্শাতে হয় না। তবে তিনি যে ‘মহর’ বা স্ত্রীধন দেবেন বলে প্ৰতিজ্ঞা করেছিলেন সে অর্থ তাকে দিতে হবে। অবশ্য না দিতে পারলে যে তালাক মকুব হবে তাও নয়। স্ত্রী তাঁর ভূতপূর্ব স্বামীর মাইনে ‘অ্যাটাচ’ করতে পারেন, আদালতের ডিগ্রি নিয়ে সম্পত্তি ক্ৰোক করতে পারেন; এক কথায় উত্তমণ অধমৰ্ণকে যতখানি নাস্তানাবুদ করতে পারেন ততখানি তিনিও করতে পারেন।
উত্তম প্রস্তাব। এখন প্রশ্ন স্ত্রী যদি স্বামীকে বর্জন করতে চান তবে তিনি পারেন কি না? যদি মনে করুন, স্ত্রী বলেন, ‘এই রইল তোমার স্ত্রী-ধন, আমাকে খালাস দাও’। কিম্বা যদি বলেন, ‘তুমি আমাকে যে স্ত্রীধন দেবে বলেছিলে সে স্ত্রীধনে আমার প্রয়োজন নেই, আমি তোমাকে বর্জন করতে চাই, তবু স্বামী সাফ না’ বলতে পারেন। অবশ্য স্ত্রী স্বামীকে জ্বালাতন করার জন্য তার স্ত্রীধন তদণ্ডেই চাইতে পারেন-করণ শ্ৰীধন তলব করার হক স্ত্রীর সব সময়ই আছে, স্বামী তালাক দিতে চাওয়া না-চাওয়ার উপর সেটা নির্ভর করে না। স্বামী যদি সে ধন দিতে অক্ষম হন তা হলেও স্ত্রী তালাক পেলেন না। অর্থাৎ তিনি যদি পতিগৃহ ত্যাগ করে ভিন্ন বিবাহ করতে চান তবে সে বিবাহ অসিদ্ধ; শুধু তাই নয়, পুলিশ স্ত্রী এবং নবীন স্বামী দুজনের বিরুদ্ধে বিগেমি’র মোকদ্দমা করতে পারবে।