কিন্তু কোনো ব্যাপক অনুবাদকার্য কেউ হাতে তুলে নেন নি। তার কারণ অনুসন্ধান করতে হলে অনেক গবেষণার প্রয়োজন। উপস্থিত শুধু সব চেয়ে বড় দুঃখটা নিবেদন করি।
রবীন্দ্রনাথের গানের মত হুবহু গান জর্মনে আছে এবং সেগুলি জর্মনদের বড় প্রিয়। এগুলোকে লীডার’ বলা হয় এবং শুধু লীডার গাইবার জন্য বহু জর্মন গায়ক প্রতি বৎসর প্যারিস, লন্ডন যায়। এসব লীডারের কোনো কোনো গানের কথা দিয়েছেন গ্যোটের মত কবি, আর সুর দিয়েছেন বেটোফোনের মত সঙ্গীতকার।
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের গানে গ্যোটে বেটোফেনের সমন্বয়। একাধারে এই দুই সৃজন পন্থার সম্মেলন হয়েছিল বলে রবীন্দ্র-সঙ্গীত জর্মন লীডারের চেয়ে বহুগুণে শ্ৰেষ্ঠ। অনুভূতির সূক্ষ্মতা, কল্পনার প্রসার, এবং বিশেষ করে সুর ও কথার অঙ্গাঙ্গী বিজড়িত অর্ধনারীশ্বর পৃথিবীর কোনো গান বা ‘লীডার’ জাতীয় সৃষ্টিতে আজ পর্যন্ত অবতীর্ণ হন। নি—রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে রকম হয়েছে।
বাঙালিকে বাদ দিলে রবীন্দ্ৰ-সঙ্গীতের প্রকৃত মূল্য একমাত্র জর্মনিই ঠিক বুঝতে পারবে।
কোনো ব্যাপক অনুবাদ তো হ’লই না, এমন কি রবীন্দ্রনাথের গানও জর্মন-কণ্ঠে গীত হ’ল না।
কাজেই ‘সাত দিনের ভানুমতি’ আট দিনের দিন কেটে গেল। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস যেদিন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মত অনুবাদক কবি ইয়োরোপে জন্মাবেন সেদিন ইয়োরোপ
‘চিনে নেবে চিনে নেবে তারে।’।।
শমীম
আমার বন্ধু শামীম মারা গিয়েছে। শামীম। এ-সংসারে কোনো কীর্তি রেখে যেতে পারে নি, যার জন্যে লোকে সভাস্থলে কিংবা কাগজে শোক প্রকাশ করবে। তার আত্মজন এবং নিতান্ত অন্তরঙ্গ বন্ধু ছাড়া তাকে কেউ বেশিদিন স্মরণ করবে না।
তার কথা আপনাদের জোর করে শোনাবার অধিকার আমার নেই, কারণ পূর্বেই নিবেদন করেছি, শামীম কোন কীর্তি রেখে যেতে পারে নি। তবু যে কেন তার সম্বন্ধে লিখছি, তার কারণ সে আমার বন্ধু, আর তাই আশা, আমার বহু সহৃদয় পাঠক সেই সূত্রে তাকে মেহের চোখে দেখবেন, এবং বহু দেশ দেখবার পর বলছি, ওরকম সচ্চরিত্র ছেলে আমি কোথাও দেখি নি।
শামীম আমার ছেলের বয়সী। তার জন্মের প্রায় প্রথম দিন থেকেই আমি তাকে চিনি। আর এমন সুন্দর চেহারা নিয়ে সে জন্মাল, আর সে সৌন্দর্য দিন দিন এমনি বাড়তে লাগল যে, বাড়িতে যে আসত, সেই ছেলেটির দিকে না তাকিয়ে থাকতে পারত না। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিল, কী বিনয়নম্র ভদ্রসংযত ব্যবহার এবং পরদুঃখকাতর হৃদয়ভগবান তাকে দিয়েছেন। আমি নিশ্চয়ই জানি বাড়ির ভিতরে বাইরে এমন কেউ ছিল না যে শমীমের উপর বিরক্ত হয়েছে কিংবা র্যাগ করেছে।
কিন্তু তবু বলব, শামীম মন্দ অদৃষ্ট নিয়ে জন্মেছিল।
ধরা পড়ল সে সন্ন্যাস রোগে ভুগছে। সন্ন্যাসের চিকিৎসা আছে কি না জানি নে, কিন্তু একথা জানি, তার পিতা (আমার অগ্রজ-প্রতিম) চিকিৎসক হিসেবে আর আমরা পাঁচজনে বন্ধুবান্ধব হিসেবে তার চিকিৎসার কোন ত্রুটি করি নি। আর মায়ের সেবা সে কতখানি পেয়েছিল, সেকথা কি বলব? সর্বকনিষ্ঠ চিররুগ্ন কোন ছেলেকে তার মা হৃদয় উজাড় করে সেবা-সুশ্রুষা করে না?
ভগবান এতেও সন্তুষ্ট হলেন না,-তাকে দিলেন মারাত্মক টাইফয়েডু জুর। আমি দেশে ছিলুম না, ফিরে এসে দেখি জুর যাবার সময় শমীমের একটি চোখ নিয়ে গিয়েছে। আমি অনেক দুঃখকষ্ট অবিচার-অত্যাচার দেখেছি, সহজে কাতর হই নে, কিন্তু শমীমের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি যে আঘাত পেয়েছিলুম। সে আঘাত যেন আমার চেয়ে দুর্বল লোককে ভগবান না দেন।
শমীমের বাপ খুড়া ঠাকুর্দা সকলেই গভীর প্রকৃতির-শামীমও ছেলেবেলা থেকে শাস্তস্বভাব ধরত, এখন সে ক্রমে ক্ৰমে গভীর হতে লাগল। পড়াশোনা তার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং কখনো যে করতে পারবে সে ভরসা ক্রমেই ক্ষীণ হতে লাগল। হয়তো তাই নিয়ে মনে মনে তোলপাড় করত-আশ্চর্য কি, যে ছেলে অল্পবয়সে লেখাপড়ায় সকলের সেরা ছিল তার সব লেখাপড়া চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো মর্মদ্ভদ ব্যাপার কি হতে পারে?
বিশ্বাস করবেন না, ঐ গাভীর্যের পিছনে কিন্তু তার ছিল প্রচুর রসবোধ। আমাকে খুশি করবার জন্য সে আমাদের বাড়ি-নং পার্ল রোড সম্বন্ধে একটি রচনা লেখে। তাতে আমাদের সকলের রসময় (অনেকটা আইরিশ ধরনের হিউমার) বর্ণনার পর ছিল উপরের তলায় তার দাদামশায়ের বর্ণনার ফিনিশিং টাচু। দাদামশায় আসলে কুষ্ঠিয়ার লোক, ‘এটা’ ‘সেটা’ না বলে বলেন ইডা’, ‘সিডা’, আর বুড়োমানুষ বলে সমস্ত দিন বাড়ির এঘর ওঘর করে বেড়ান। তার বর্ণনা শামীম দিল এক লাইনে—’আর দাদামশাই তো সমস্ত দিন ‘ইডা’ ‘সিডা’ নিয়ে আছেন।
শমীমের বড় ভাই শহীদ তখন প্রেমে পড়েছে। মেয়েটির নাম হাসি। খানার টেবিলে একদিন জল্পনাকল্পনা হচ্ছে, একটা চড়ুই-ভাত করলে হয় না? শহীদ গভীর হয়ে বসে আছে–আমি শুধালুম, ‘তুমি আসছে তো?’ শহীদ বলল, ‘না।’
শামীম বলল, ‘ও আসবে কেন? আমরা তো ‘হাসি’ না।’
অর্থাৎ তার ডার্লিং ‘হাসি’ তো আমাদের সঙ্গে চড়ুইভাতে আসবে না এবং আহা, শহীদ কতই না Jolly chap–আমরাই শুধু গম্ভীর।
কিন্তু আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করত। তার পরোপকার করার প্রচেষ্টা। ৪৭-এর দাঙ্গার সময় আমাদের বাড়িতে প্রায় সত্তর জন হিন্দু নরনারী আশ্রয় নেন-আমি তখন দক্ষিণে— ফিরে এসে শুনি গুণ্ডারা বাড়ি আক্রমণ করেছিল, শামীম নিৰ্ভয়ে এদের সেবা করেছে; আমি আশ্চর্য হই নি।