বড়দিনের কয়েক দিন পরে গিয়েছিলুম। জেরুজালেম-বোৎলেহেমের বাস সার্ভিস আমাদের স্টেট বাসের চেয়ে অনেক ভালো (বাসের উপর পলায়মান ব্যান্ত্রের ছবি এঁকে কর্তারা ভালই করেছেন—বাঘ পর্যন্ত ভিড় দেখে ভয়ে পালাচ্ছে)। পকেটে গাইড বুক-পাণ্ডার ‘এরজাৎস’-কঁধে ক্যামেরা—হাতে লাঠি। আধা ঘণ্টার ভিতর বোৎলেহেম গ্রামে নামলুম।
ভেবেছিলুম, দেখতে পাবো, বাইবেল-বর্ণিত ভাঙাচোরা সরাই আর জরাজীর্ণ আস্তাবল-যেখানে র্যীশু জন্ম নিয়েছিলেন। সব কঙ্গুর। সব কিছু ভেঙেচুরে তার উপর দাঁড়িয়ে এক বিরাট গির্জা।
গির্জাটি প্ৰিয়দৰ্শন অস্বীকার করি নে। আর ভিতরে মেঝের উপর যে মোজায়িক বা পাথরে-খচা। আলপনা দেখলুম তার সঙ্গে তুলনা দেবার মত রসদৃষ্টি সেন্ট সোফিয়া, সেন্ট পল কোথাও আমি দেখি নি। সে কথা আরেক দিন হবে।
গাইড বুকে লেখা ছিল, গির্জার নিচে ভূগর্ভে এখনো আছে সেই আস্তাবল-যেখানে প্ৰভু যীশু জন্মগ্রহণ করেন। সেই গহ্বরে ঢুকতে যেতেই দেখি সামনে এক ছ-ফুটি পাণ্ডা। বাবরী চুল, মান-মনোহর গালি-কম্বল দাঁড়ি, ইয়া গোপ, মিশকালো আলখাল্লা, মাথায় চিমনির চোঙার মত টুপি, হাতে মালা-তার এক একটি দানা বেবি সাইজের ফুটবলের মত। পাষ্ট্ৰীপাণ্ডার অর্ধ-নারীশ্বর।
গুরু-গভীর কণ্ঠে শুধাল, ‘হোয়াট ল্যানগুইজ? কেল লীগ? বেলশে শপ্ৰাখে? লিসান এ?’—প্রায় বারোটা ভাষায় জিজ্ঞেস করল আমি কোন ভাষা বুঝি।
সবিনয় বললুম, ‘হিন্দুস্থানী।’
বলবে, ‘দস পিয়াস্তর।’ অর্থাৎ দশ পিয়াস্তুর (প্রায় এক টাকা) দৰ্শনী দাও।
‘দস’ ছাড়া অন্য কোন হিন্দুস্থানী সে জানে না বুঝলুম, কিন্তু তাই বা কি কম? আমি অবাক হয়ে ইংরেজিতে বললুম, ‘প্ৰভু যীশুর জন্মভূমি দেখতে হলে পয়সা দিতে হয়?’
বললে, ‘হ্যাঁ।’
অনেক তর্কাতর্কি হল। আমি বুঝিয়ে বললুম, ‘আমি ভারতীয়, খ্ৰীষ্টান নই, তবু সাতসমুদ্র-তেরো-নদী পেরিয়ে এসেছি সেই মহাপুরুষের জন্মভূমি দেখতে যিনি সবচেয়ে বেশি। চেষ্টা করেছিলেন গরিব-ধনীর তফাত-ফারাক ঘুচিয়ে দেবার জন্য, যিনি বলেছিলেন কেউ কামিজটা চাইলে তাকে জোব্বাটি দিয়ে দেবে-আর তার জন্মভূমি দেখবার জন্য দিতে হবে পয়সা?
শুধু যে চোরাই ধর্মের কাহিনী শোনে না তা নয়। আমি উলটো পথ নিলুম-পাণ্ডা ফিরে পর্যন্ত তাকাল না।
গাইড বুকে লেখা ছিল, গহ্বরে যাবার দুটি রাস্তা। একটি গ্ৰীক অর্থডক্স প্রতিষ্ঠানের জিন্মায়, অন্যটি রোমান ক্যাথলিকদের। গেলুম সেটির দিকে-গির্জাটি ঘুরে সেদিকে পৌঁছতে হয়।
এখানে দেখি আরেক পাণ্ডা-যেন পয়লাটার যমজ। বেশভূষায় ঈষৎ পার্থক্য।
পুনরপি সেই সদালাপ’। ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল।’ অম্মো না-ছোড়-বন্দা।
দিল-দরাজ, খোলা-হাত পাঠক হয়ত অসহিষ্ণু হয়ে বলবেন, ‘তুমি তো আচ্ছা ত্যাঁদোড় বাপুঃ এত পয়সা খর্চা করে পৌঁছলে মোকামে—এখন দু-পয়সার চাবুক কিনতেচাও না হাজার টাকার ঘোড়া কেনার পর?’ তা নয়, আমি দেখতে চাইছিলুম পাণ্ডাদের দৌড়টা কতদূর অবধি।
এবারে হার মানবার পূর্বে শেষ বাণ হানলুম।
বললুম, ‘দেশে গিয়ে কাগজে লিখব, রোমান ক্যাথলিক প্রতিষ্ঠান কি রকম প্ৰভু যীশুর জন্মস্থান ভাঙিয়ে পয়সা কামাচ্ছে। আমাদের দেশেও কমুনিটি আছে।’
বলে লাঠিটা বার তিনেক পাথরে ঠুকে ফিরে চললুম ঘোঁত-ঘোঁত করে বাস স্ট্যান্ডের দিকে।
পাণ্ডা ডাকলে, ‘শোন।’
আমি বললুম, ‘হুঁঃ!’
‘তুমি সত্যি এত টাকা খরচ করে এখানে এসে দশ পিয়াস্তরের জন্য তীর্থ না দেখে চলে যাবে?’
‘আলবত। প্রভুর জন্মভূমি দেখার জন্য পয়সা দিয়ে প্রভুর স্মৃতির অবমাননা করতে চাই নে।’
খ্যাঁস-খ্যাঁস করে দাড়ি চুলকোল অনেকক্ষণ ধরে। তারপর ফিস-ফিস করে কানের কাছে মুখ-বোটকা রসুনের গন্ধ—এনে বলল, ‘যদি প্রতিজ্ঞা করো কাউকে বলবে না ফ্রী ঢুকতে দিয়েছি, তবে-’
আমি বললুম, আচ্ছা, এখানে তোমার ব্যবসা মাটি করব না। কিন্তু দেশে গিয়ে বলতে পারব তো?’
তখন হার মানল। আমরা বহু লঙ্কা জয় করেছি!!
ভারতীয় নৃত্য
নৃত্য জীবনীশক্তির চরম বিকাশ। যে-সব কলা দ্বারা মানুষ তাহার সৌন্দর্যানুভূতি প্রকাশ করে, তাহাদের গভীরতম মূল নৃত্যরস হইতে প্রাণসঞ্চয় করে। অন্যান্য কলা সৃষ্টি হইবার বহু পূর্বে মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত, আড়ম্বরহীন নৃত্য দ্বারা তাহার অনুভূতি প্ৰকাশ করিয়াছে—অপরের হৃদয়ে সেই রস সঞ্চারিত করিবার জন্য এই সরল কলাই তখন তাহার একমাত্র আশ্রয়ও ছিল। আদিম মানবের বাদ্যযন্ত্র ছিল না, ধ্বনি বিশ্লেষণ করিয়া সঙ্গীত সৃষ্টি করিতে সে তখনও শিখে নাই, প্রতিমা নির্মাণের যন্ত্রপাতি তাহার ছিল না, চিত্রাঙ্কনের সরঞ্জাম তাহার কাছে তখনও অজানা। অনুভূতি প্রকাশ করিবার একমাত্র পন্থা ছিল তাহার নিজের দেহ; সেই দেহ সে সাবলীল ছন্দে তালে তালে আন্দোলিত করিয়া তাহার সুখ-দুঃখ, ভয়-ঘৃণা প্রকাশ করিত। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অনুভূতি সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর রূপ গ্ৰহণ করিতে লাগিল-নৃত্যও তাহার সঙ্গে যোগ রাখিয়া সুকুমার কলায় পরিণত হইল; মানুষ নৃত্য দ্বারা তাহার সূক্ষ্মতম ও গভীরতম অনুভূতিকে রূপ দিতে শিখিল।
সলিল ছন্দে, তালমানযোগে দেহ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আন্দোলন দ্বারা মানুষ যখন তাহার জীবনীশক্তির চরম সত্তাকে সপ্রকাশ করিয়া তুলে তখনই তাঁহা নৃত্যের রূপ ধারণ করে। নৃত্য তখন মানুষের নব নব সৌন্দর্যানুভূতি, সত্যের সঙ্গে তাহার অন্তরতম পরিচয় নব নব রূপে উন্মোচন করিয়া প্রকাশ করে। তাই শুদ্ধ, অকৃত্ৰিম নৃত্য সম্পূর্ণ বাধাবন্ধহীন। দেশ ও কালের ক্ষুদ্র গণ্ডীর ভিতরে তাহাকে রুদ্ধ করা, কুসংস্কার দ্বারা তাহাকে আচ্ছন্ন করার অর্থ আর কিছুই নয়—তাহার অফুরন্ত জীবন-উৎসকে রুদ্ধ করা, তাহার স্বাধীনতাকে পঙ্গু করা। আমাদের দেশের হৃদয় একদিন স্বতঃস্ফুর্ত, বাধাবন্ধহীন আনন্দের নৃত্যছন্দে আন্দোলিত হইয়াছিল, আজ সেই ধারা বইন্ধ হইয়া ব্যবসায়ী নটনটীদের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অন্ধকূপের সৃষ্টি করিয়াছে। রোগজীৰ্ণ, বিষাক্ত, বিলাসব্যসনীদের উত্তেজনা দানেই আজ তাহার চরম আনন্দ, পরম লাভ। ক্ষুদ্র হৃদয়ের অবসর বিনোদন ও ক্ষণস্থায়ী চিত্তচাঞ্চল্যের প্রকাশ করাকেই এখন নৃত্যের আদর্শ বলিয়া ধরিয়ালওয়া হইয়াছে।