ডান হাতে কনুই অবধি সোনার চুড়ি-বঁ হাতে কবজের মত বাঁধা হোমিওপ্যাথিক রিস্টওয়াচ। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডিনারের কত বাকি? কটা বেজেছে?’ বলেই লজ্জা পেলেন, কারণ ভুলে গিয়েছিলেন নিজের হাতেই বাঁধা রয়েছে ঘড়ি। কিন্তু লাল হলেন না, কারণ রুজ আগে-ভাগেই এত লাল করে রেখেছে যে, আর লাল হবার ‘পার্কিঙপ্লেস’ নেই।
হাতে? যান মশাই,-আমার অতশত মনে নেই। হালকা সবুজ জর্জেটের সঙ্গে রক্তেরাঙা ব্লাউজ। কপালে সবুজ টিপ। শাড়ির সঙ্গে রঙ মিলিয়ে বঁ হাতে ঝুলছে ব্যাগ, কিন্তু ব্যাগের স্ট্র্যাপটার রঙ মেলানো রয়েছে রক্ত-রাঙা ব্লাউজের সঙ্গে এবং তাকে ফের মেলানো হয়েছে স্যান্ডেলের স্ট্র্যাপের সঙ্গে। আর কোথায় কোথায় মিল অমিল আছে দেখবার পূর্বেই তিনি সরে পড়লেন। ডান হাতে কিছু ছিল? কী মুশকিল!
আরে! মারোয়াড়ি ভদ্রলোকরা কি পাটিতে মহিলাদের আনতে শুরু করেছেন? কবে থেকে জানতুম না তো।
একদম খাঁটি মারোয়াড়ি শাড়ি। টকটকে লাল রঙ-ছোটো ছোটো বোট্টাদার। বেনারসী র্যাপার। সেই কাপড় দিয়েই ব্লাউজ-জরির বোট্টা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সকাল বেলা হাওড়ায় নামলে ব্রিজ পেরিয়ে হামেশাই এ রকম শাড়ি দেখতে পাই–মহিলারা স্নান সেরে ফিরছেন। সেই শাড়ি এখানে? হাতে আবার লাইফ বেল্ট সাইজের কাঁকন।
মাথার দিকে চেয়ে দেখি, না, ইনি মারোয়াড়ি নন। চুলটি গুটিয়েছেন একদম পাকাপোক্ত গ্রেতা গার্বে স্টাইলে। কঁধের উপর নেতিয়ে পড়ে ডগার দিকে একটুখানি ঢেউখেলানো। শুধুচুলটি দেখলে তামা-তুলসী স্পর্শ করে বলতুম, জীবনের শেষ স্বপ্ন সফল হল-গ্রেতার সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে। কিন্তু কেন হেন জঙ্গলি শাড়ির সঙ্গে মডার্ন চুল?
নাসিকাগ্রে মনোনিবেশ করে ধ্যান করে হৃদয়ঙ্গম করলুম তত্ত্বটা। শাড়ি ব্লাউজের কনট্রাসট ম্যাচিঙের দিন গেছে। এখন নব নব কনট্রাসট-এর সন্ধান চলেছে। এ হচ্ছে প্রাচীন পন্থা আর আধুনিক ফ্যাশানের দ্বন্দ্ব। গলার নীচে ত্রয়োদশ শতাব্দী-উপরে বিংশ। প্রাণভরে বাঙালি মেয়ের বুদ্ধির তারিফ করলুম। উচ্চকণ্ঠে করলেও কোনো আপত্তি ছিল না। সে হট্টগোলের ভিতর এটম বামের আওয়াজও শোনা যেত না। কি করে খানার ঘণ্টা শুনতে পেলুম, খোদায় মালুম।
হাওড়া থেকে শেয়ালদা সাইজের খানা-টেবিল। টার্কি পাখিরা রোস্ট হয়ে উধৰ্বপদী হয়েছেন অন্তত শাজনা, মুরগী-মুসল্লম অগুনতি, সাদা কেঁচোর মত কিলবিল করছে ইতালির মাক্কারোনি হাইনৎসের লাল টমাটো সসের ভিতর, আন্ডার রাশান স্যালাড গায়ে কম্বল জড়িয়েছে প্যোর ব্রিটিশ মায়েনেজের ভিতর, চকলেট রঙের শিককাবাবের উপর আঁকা হয়েছে সাদা পেঁয়াজ-মূলোর আলপনা, গরম মশলার কাথের কাদায় মুখ গুঁজে আছেন রুইমাছের ঝাঁক, ডাঁটার মত আটা আটা এসপেরেগাস টিন থেকে বেরিয়ে শ্যাম্পেনের গন্ধ পেয়ে ফুলে উঠেছে, পোলাওয়ের পিরামিডের উপর সসেজের ডজন ডজন কুতুবমিনার।
প্ৰভু যীশু জন্ম নিলেন খড়বিচুলির মাঝখানে—আর তার পরব হল শ্যাম্পেনে টার্কিতে!!
রবীন্দ্ৰনাথ বলেছেন,-
‘নামিনু শ্ৰীধামে। দক্ষিণে বামে পিছনে সমুখে যত
লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্ৰাণটা করিল কণ্ঠাগত!’
এর পর পাণ্ডাদের সহ্যদয় অত্যাচারের কথা ফলিয়ে বলবার মত সাহস আমাদের মত অর্বাচীন জনের হওয়ার কথা নয়। ওস্তাদরা যখন মিয়াকী তোড়ী’ অর্থাৎ মেয়া তানসেন রচিত তোড়ী রাগিণী গান তখন গাওয়া আরম্ভ হওয়ার পূর্বে দুহাত দিয়ে দুটি কান ছুয়ে নেন। ভাবখানা এই ‘হে গুরুদেব, ওস্তাদের ওস্তাদ, যে-গান তুমি গেয়েছ সেটি গাইবার দম্ভ যে আমি প্রকাশ করলুম, তার জন্য আগে-ভাগেই মাপ চাইছি।’ সাহিত্যক্ষেত্রে আমাদেরও তাই করা উচিত-মাইকেলও তাই করেছেন। আদি কবির স্মরণে বলেছেন, ‘রাজেন্দ্রসঙ্গমে দীন যথা যায় দূর তীর্থদরশনে।’ কালিদাসও বলেছেন,-সংস্কৃতটা মনে নেই—’বজ্রমণি ছেদ করার পর সূত্র যেমন অনায়াসে মণির ভিতর দিয়ে চলে যেতে পারে, বাল্মীকির রামায়ণের পর আমার রঘুবংশ ঠিক সেইরূপ।’
শুধু এইটুকু বলে রাখি, পাণ্ডা বলতে ভারতীয় যে মহান জাতের কথা ওঠে তার কোনো জাত নেই। অর্থাৎ শ্ৰীধামের পাণ্ডা। আর আজমীঢ়ের মুসলমান পাণ্ডাতে কোনো পার্থক্য নেই-যাত্রীর প্রাণটা নিমেষে কণ্ঠাগত করবার জন্য এঁদের বজমুষ্টি ভারতের সর্বত্রই এক প্রকার। ভারতের হিন্দু-মুসলমান মিলনের এর চেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ আর কি হতে পারে? কংগ্রেস যদি এঁদের হাতে দেশের ভারটা ছেড়ে দিতেন তবে ভারত ছেদের যে কোনো প্রয়োজন হ’ত না সে বিষয় আমি স্থির-নিশ্চয়। এর জন্য মাত্র একটি প্রমাণ পেশ করছি। উভয় ডোমিনিয়নের মধ্যে সর্বপ্রকারের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ সে কথা সবাই জানেন; কিন্তু এ তথ্যটি কি লক্ষ্য করেছেন যে, শিখরা তীৰ্থ করবার জন্য দিব্য পাকিস্তান যাচ্ছেন, পাকিস্তানের মুসলমানেরা হিন্দুস্থানের আজমীঢ় আসছেন, পূর্ব-পাঞ্জাবের কাদিয়ান গ্রাম যাচ্ছেন? পাণ্ডার ব্যবসা দুনিয়ার প্রাচীনতম ব্যবসা—ওটাকে নষ্ট করা কংগ্রেস লীগের কর্ম নয়।
সে কথা যাক। আমি বলছিলুম, বিদেশ যাওয়ার পূর্বে আমার বিশ্বাস ছিল পাণ্ডাজগতের অশোক-স্তম্ভ এবং কুতুবমিনার ভারতীয় হিন্দু এবং মুসলমান পাণ্ডা। জেরুজালেমে গিয়ে সে ভুল ভাঙিল।
আমি তীর্থপ্ৰাণ। অর্থাৎ তীর্থ দেখলেই ফুল চড়াই, শীরণী’ বিলাই। ভারতীয় তাবৎ তীর্থ যখন নিতান্তই শেষ হয়ে গেল তখন গেলুম জেরুজালেম। ইহুদি, খ্ৰীষ্টান, মুসলমান এই তিন ধর্মের ত্ৰিবেণী জেরুজালেমে। বিশ্বপাণ্ডার ইউ.এন. ও. ঐখানেই। সেখান থেকে গেলুম বোৎলেহেম-প্ৰভু যীশুর জন্মস্থান।