কমুনিস্ট ভায়ারা (কমরেডরা) মনস্থির করেছেন গণ-কলা বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ কলা এবং সেই গণ-নৃত্য শহরে বুৰ্জ্জুয়াদের দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিতে হবে। তাই মেহন্নত, ততোধিক তাকলিফা বরদাস্ত করে তারা শহরে স্টেজ খাটান, পর্দা ঝোলান, রঙ-বেরঙের আলোর ব্যবস্থা করেন। আর তারপর চালান হৈদ্রাবাদী কিম্বা কুয়াম্বতুরেরও হতে পারে,— জানি নে, ধোপার নাচ। কিম্বা গুজরাতী গরীবা! বলেন, ‘পশ্য, পশ্য’—থুড়ি, দ্যাখ, দ্যাখ, এরেই কয় লাচ।’
পূর্বেই নিবেদন করেছি। গণ-নৃত্য নিন্দনীয় নয়, কিন্তু যে গণ-নৃত্য একঘেয়ে এবং বৈচিত্র্যহীন হতে বাধ্য, সেই নাচ দেখতে হবে ঝাড়া আধঘণ্টা ধরে? ঘন ঘন হাততালি দিয়ে বলতে হবে ‘মরি, মরি’? দু-চার মিনিটের তরে যে এ নাচ দেখা যায় না, সে কথা বলছি নে।
আলো-অন্ধকারে ভিন গাঁয়ে যাচ্ছেন, দেহ ক্লান্ত, মন অবসন্ন, চাঁদ উঠি উঠি করেও উঠছেন না–এমন সময় দেখতে পেলেন গায়ের মন্দিরের আঙিনায় একপাল মেয়ে মাথায় ছ্যাদা-ওলা কলসীতে পিদিম রেখে চক্কর বানিয়ে ধীরে ধীরে মন্দমধুর পা ফেলে নাচছে। জানটা তার হয়ে গেল। দুমিনিট দাঁড়িয়ে আলোর নাচ আর মেয়েদের গান, ‘সোনার দেওর, আমার হাত রাঙাবার জন্য মেহেদী এনেছ কি?’ দেখে নিলেন। কিন্তু তারপর? যে নাচ আস্তে আস্তে বিকাশের দিকে এগিয়ে যায় না, বিচিত্র অঙ্গভঙ্গ, পদবিন্যাসের ভিতর দিয়ে যে নাচ পরিসমাপ্তিতে পৌঁছয় না, সে নাচ দেখবেন কতক্ষণ ধরে? এ-নাচের পরিসমাপ্তি কোনো রসসৃষ্টির আভ্যন্তরীণ কারণে হয় না, এর পরিসমাপ্তি হয় নর্তকীরা যখন ক্লাস্ত হয়ে পড়েন তখনই।
আলো-অন্ধকার, চাদ উঠি-উঠি, শ্যাওলামাখা ভাঙা দেউলের পরিবেশ থেকে হাঁচিকা টানে ছিড়ে-নিয়ে-আসা নৃত্য শহরের স্টেজে মূৰ্ছা তো যায় বটেই, তার উপর মাইক্রোফোনযোগে চিৎকার করে তারস্বরে আপনাকে বলা হয়, ‘এ নাচ বড় উমদা নাচ-’। এ নাচ আপনাকে দেখতে হয় আধঘণ্টা ধরে! আধঘণ্টা ধরে দেখতে হয় সেই নাচ, যার সর্ব পদবিন্যাস মুখস্থ হয়ে যায় আড়াই মিনিটেই।
পনরো টাকার সীটে বসে (টাকাটা দিয়েছিলেন আমার এক গোলাপী অর্থাৎ নিমকমুনিস্টি কমরেড) আমি আর থাকতে না পেরে মুখে আঙুল পুরে শিটি দিয়েছিলুম প্ৰাণপণ। হৈ হৈ রৈ রৈ। মার মার কাট কাট। এ কী বর্বরতা?
আমি বললুম, ‘কেন বাওয়া, আপত্তি জানাবার এই তো প্রলেটারিয়েটস অব দি প্রলেটারিয়েট কায়দা।’
বড় দিন
বাইবেলে বলা হয়েছে পূব থেকে তিন জন ঋষি প্যালেস্টাইনের জুডেয়া প্রদেশের রাজা হেরোডের কাছে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ইহুদিদের নবীন রাজা কোথায় জন্ম নিয়েছেন? আমরা পূর্বকাশে তাঁর তারা দেখতে পেয়ে তাকে পুজো করতে এসেছি।
সেই তারাই তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল বোৎলেহেম-যেখানে প্ৰভু যীশু জন্ম নিয়েছিলেন। মা মেরী আর তার বাগদত্ত যোসেফ পান্থশালায় স্থান পান নি বলে আশ্রয় নিয়েছিলেন পান্থশালার অশ্বালয়ে। তারই মাঝখানে কুমারী মেরী জন্ম দিলেন এ জগতের নব জন্মদাতা প্ৰভু যীশুকে।
দেবদূতরা মাঠে গিয়ে রাখাল ছেলেদের সুসংবাদ দিলেন-প্ৰভু যীশু, ইহুদিদের রাজা জন্ম নিয়েছেন। তারাও এসে দেখে, গাধা-খচ্চর, খড়-বিচুলির মাঝখানে মা-জননীর কোলে শুয়ে আছেন রাজাধিরাজ।
এই ছবিটি এঁকেছেন যুগ যুগ ধরে বহু শিল্পী, বহু কবি, বহু চিত্রকর। নিরাশ্রয়ের ঘরে এসে আশ্রয় নিলেন বিশ্বজনের আশ্রয়-দাতা।
* * *
বাইরের থেকে গভীর গুঞ্জরণ শুনে মনে হল বিদ্যালয়ের ভিতর বুঝি তরুণ সাধকেরা বিদ্যাভ্যাস করছেন। জানা ছিল টোল-মাদ্রাসা নয়, তাই ভিতরে ঢুকে ভিরমি যাই নি।
ক’শ নারী পুরুষ ছিলেন আদম-শুমারী করে দেখি নি। পুরুষদের সবাই পরে এসেছেন ইভূনিং ড্রেস। কালো বনাতের চোস্ত পাতলুন-তাঁর দুদিকে সিল্কের চকচকে দু ফালি পট্টি; কচ্ছপের খোলের মত শক্ত শার্ট, কোণভাঙা কলার-ধবধবে সাদা; বনাতের ওয়েসটু কোট আর কোটের লেপেলে সেই সিল্কের চকচকে ট্যারচা পট্টি; কালো বো। ফুটে উঠেছে সাদা শার্ট কলারের উপর-যেন শ্বেত সরোবরে কৃষ্ণা কমলিনী। পায়ে কালো বার্নিশের জুতো—হাতে গেলাস।
কিংবা শার্ক-স্কিনের ধরনের সাদা মসৃণ পাতলুন। গায়ে গলাবন্ধ প্রিনস কোট’- সিক্স-সিলিন্ডারি অর্থাৎ ছ-বোতামওয়ালা। কারো বোতাম হাইদ্রাবাদী চৌকো, কারো বা বিন্দরী গোল-কালোর উপরে সাদা কাজ। একজনের বোতামগুলো দেখলুম খাস জাহাঙ্গীরশাহী মোহরের l-হাতে গেলাস।
তারি মধ্যিখানে বসে আছেন এক খাঁটি বাঙালি নটবর। সে কী মোলায়েম মিহি চুনটকরা শান্তিপুরে ঘি রঙের মেরিনার পাঞ্জাবি আর তার উপরে আড়করা কালো কাশ্মীরী শালে সোনালি জরির কাজ। হীরের আংটি বোতাম ম্যাচ করা, আর মাথায় যা চুল তাকে চুল না। বলে কৃষ্ণমুকুট বললেই সে তাজমহলের কদর দেখানো হয়। পায়ে পাম্পসু-হাতে গেলাস।
‘দেশসেবক ও দু’একজন ছিলেন। গায়ে খন্দর-হাতে? না, হাতে কিচ্ছ না। আমি আবার সব সময় ভালো করে দেখতে পাই নে-বয়স হয়েছে।
কিন্তু এ সব নস্যি। দেখতে হয় মেয়েদের। ব্যাটাছেলেরা যখন মনস্থির করে ফেলেছে, সাঁঝের ঝোকে সাদা কালো ভিন্ন অন্য রঙ নিয়ে খেলা দেখাবে না। তখন এই দুই স্বর সা আর রে দিয়ে কি ভেস্কিই বা খেলবে?
হোথায় দেখো, আহা-হা-হা! দুধের উপর গোলাপী দিয়ে ময়ুরকষ্ঠী-বাঙ্গালোরী শাড়ি! জরির আঁচল! আর সেই জরির আঁচল দিয়ে ব্রাউজের হাতা। ব্লাউজের বাদ-বাকি দেখা যাচ্ছে না, আছে কি নেই। তাই বলতে পারব না। বোধ হয় নেই—না থাকাতেই সৌন্দর্য বেশি। ফরাসীরা কি এ জিনিসকেই বলে ‘দোকোলতে’? বুক-পিঠ-কাটা মেমসায়েবদের ইভনিং ফ্রক এর কাছে লজ্জায় জড়সড়।