সবগুলোর, মানে সব কটাই অতি সংক্ষেপে ঠিক ঠিক দেওয়া হয়েছে। মাত্র একটি ভুল—মেঘদূতকে Eops বা মহাকাব্য বলা হয়েছে। উড়ে বামুনরা যে গঙ্গামানের সময় ডলাই-মলাই ও ফোঁটা-তিলক কেটে দেন। সে কথাটি বলা হয়েছে, কিন্তু আমাদের যে রান্নার নামে কি বিষ খেতে দেন, সেটা বলতে ভাগনার ভুলে গিয়েছেন। B.A. উপাধি ভাগনার জর্মনদের বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং M.A. যে লাতিন Magister Artium সেটা বলতে ভোলেন নি। আশা করতে পারি আমাদের প্রতি জর্মনদের ভক্তি বেড়েছে।
আম-কাঁঠাল, শিউলি-বকুল বহু গল্পে বার বার এসেছে, কিন্তু ফুল আর ফলের ছয়লাপে ভাগনার ঘাবড়ে গিয়ে সেগুলো বোঝাবার চেষ্টা করেন নি। তবে তিনি রজনীগন্ধার প্রতি কিঞ্চিৎ পক্ষপাতদুষ্ট।
অনুবাদ কি রকম হয়েছে? অতি উৎকৃষ্ট সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, পদে পদে ছত্ৰে ছত্রে এই কথাটি বার বার বোঝা যায় যে, দূর বার্লিনে বসে কি গভীর ভালবাসা দিয়ে ভাগনার অনুবাদগুলো করেছেন এবং সেই ভালবাসাই তাকে বাংলার ছোট গল্পের অন্তস্তলে নিয়ে গিয়েছে।
ভৈরবী কোন সময় গাওয়া হয়, ফুলশয্যাতে কে শোয়, মেদিনীপুর কোন দিকে, হাতের নোয়া আর হুলুধ্বনি কাদের একচেট, কৃত্তিবাস কাশীরাম দাস কে এই সব বিস্তর বায়নাক্কা বরদাস্ত করে জর্মন ১৯২৮ সালে এই বই পড়েছে আর সুদূর বাংলার হৃদিরস আস্বাদন করবার চেষ্টা করেছে।
বর্বর নয় তো কি!
—–
১। রবীন্দ্ৰনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ থাকতে ভাগনার কেন যে সেগুলো কাজে লাগালেন না, তা বোঝা গেল না!
২। S.D.P.Roy Chowdhury; A. Bhaduri; J.C. Huji; J.Bose; S.C. Bhattacharya.
৩। ইনি শব্দতাত্ত্বিকদের সুপরিচিত।
৪। জীবিত মৃত সকলের নামের পূর্বেই ভাগনার ‘শ্ৰী’ ব্যবহার করেছেন। বাংলা ‘শ’ বুঝতে হলে জর্মানে sch (ইংরাজিতে Schedule-এর sch), ‘জ’ বুঝাতে হলে ‘dsch, চা বুঝাতে হলে ‘sch’, ‘য়’ বুঝাতে হলে ‘J’ ব্যবহার করা হয়েছে।
বিশ্বভারতী
কবি, শিল্পী–স্রষ্টমাত্ৰই স্পর্শকাতর হয়ে থাকেন। এবং সেই কারণেই আর পাঁচজনের তুলনায় এ জীবনে তারা এমন সব বেদনা পান যার সঙ্গে আমাদের কোনো পরিচয় নেই। রাজনৈতিক কিংবা ব্যবসায়ী হতে হলে গণ্ডারের চামড়ার প্রয়োজন—গণ্ডারের চামড়া নিয়ে কোনো কবি আজ পর্যন্ত সার্থক সৃষ্টি করে যেতে পারেন নি।
জীবনের বহু ক্ষেত্রে রবীন্দ্ৰনাথ বহু অপ্রত্যাশিত আঘাত পেয়েছিলেন। তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের আশীর্বাদ পান; তৎসত্ত্বেও বাঙলাদেশ বহুদিন ধরে তাকে কবি বলে স্বীকার করতে চায় নি। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে বহু গণ্যমান্য লোক এমন সব অন্যায় আক্রমণ এবং আন্দোলন চালান যে রবীন্দ্রনাথকে হয়তো অল্প বয়সে কীটসের মতো ভগ্নহৃদয় নিয়ে ইহলোক পরিত্যাগ করতে হত। রবীন্দ্ৰনাথ যে বহু বেদনা পেয়েও কীটসের মতো ভেঙে পড়েন নি তার অন্যতম প্রধান কারণ, ধর্মে তার অবিচল নিষ্ঠা ছিল এবং দ্বিতীয়টি মহর্ষি স্বহস্তে রবীন্দ্ৰনাথের নৈতিক মেরুদণ্ডটি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।
এ জীবনে রবীন্দ্ৰনাথ বহু বেদনা পেয়েছেন এবং তার খবর বাঙালিমাত্রই কিছু না কিছু রাখেন। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, বিশ্বভারতীয় নবপ্রতিষ্ঠান উপলক্ষে, তারই একটি নিবেদন করি।
১৯২১ সালে রবীন্দ্ৰনাথ বিশ্বভারতীর’ প্ৰতিষ্ঠা করেন কিংবা বলতে পারি। যে ইস্কুলটি (পূর্ব বিভাগ) প্রায় কুড়ি বৎসর ধরে বাঙলা বা বাঙলার বাইরে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিল তার সঙ্গে একটি কলেজ (উত্তর বিভাগ) যোগ দিয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে সঙ্গে প্ৰাচ্য-প্রতীচ্যের নানাপ্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণা করারও ব্যবস্থা হল।
তাই গুরুদেবের বাসনা ছিল, পূর্ব-পশ্চিমের গুণীজ্ঞানীরা যেন শাস্তিনিকেতনে সম্মিলিত হয়ে একে অন্যের সহযোগিতায় বৃহত্তর ও ব্যাপকতর সাধনায় নিযুক্ত হন।
সেই মর্মে রবীন্দ্ৰনাথ আমন্ত্রণ জানালেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা পণ্ডিত অধ্যাপক সিলভা লেভিকে। ভারতীয় সংস্কৃতির সর্ববিষয়ে লেভির অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল তো বটেই, তদুপরি বৌদ্ধধর্মে বোধ করি তখনকার দিনে পশ্চিমে এমন কেউ ছিলেন না। যিনি তার সামনে সাহস করে দাঁড়াতে পারতেন।
শান্তিনিকেতনে তখন বহুতর পণ্ডিত ছিলেন। শ্ৰীযুত বিধুশেখর শাস্ত্রী, শ্ৰীযুত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী, শ্ৰীযুত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বর্গীয় এভুজ এবং পিয়ার্সন, শ্ৰীযুত নিতাইবিনোদ গোস্বামী, অধ্যাপক কলিনস বাগদানফ বেনওয়া, ক্রামরিশ, শ্ৰীযুত মিশ্রজী, শ্ৰীযুত হিডজিভাই মরিস, শ্ৰীযুত প্রভাত মুখোপাধ্যায় ও আরো বহু খ্যাতনামা লোক তখন শান্তিনিকেতনে অধ্যয়ন অধ্যাপনা করতেন।
সঙ্গীতে ছিলেন প্ৰাতঃস্মরণীয় দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্কদের ভিতর ছিলেন শ্ৰীযুত অমিয় চক্রবতী, শ্ৰীযুত প্রমথনাথ বিশী।(১)
এবং আশ্রমের সঙ্গে সাক্ষাৎভাবে সংযুক্ত না হয়েও এক ঋষি আশ্রমটিকে আপন আশীৰ্বাদ দিয়ে পুণ্যভূমি করে রেখেছিলেন। বাংলাদেশ তাকে প্রায় ভুলে গিয়েছে। ইনি রবীন্দ্রনাথের সর্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা স্বর্গীয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরর্বতীকালে লেভি এর পদপ্রান্তে বসবার সুযোগ পেয়েছিলেন।
শান্তিনিকেতন তখন পণ্ডিত এবং পাণ্ডিত্যের কিছুমাত্র অনটন ছিল না। রবীন্দ্রনাথ সে ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর সর্বশেষ কপর্দক দিয়ে-এবং এস্থলে ভক্তিভারে একথাও স্মরণ রাখা উচিত যে এই সব বড় বড় পণ্ডিতেরা যে দক্ষিণা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন সে দক্ষিণা আজকের দিনে দিতে গেলে অনেক অপণ্ডিতও অপমান বোধ করবেন।