‘ভারতীয়দের প্রেম বড় উদার, তাতে গণিকারও স্থান আছে। গণিকাদের কেউ কেউ আবার জন্মেছে বেশ্যার ঘরে, বদ খেয়ালে বেশ্যা হয় নি। গ্যেটের গণিকাকে ভগবান অবহেলা করেন নি, এদেরও হয়তো অবহেলা করবেন না।
সঙ্কলনটি সুখে-দুঃখের গল্পেই ভর্তি করা হয়েছে; হাস্যরসের গল্প নিতান্ত কম দেওয়া হয়েছে। তার কারণও আছে, দুঃখ-যন্ত্রণা সব দেশের সব মানুষেরই এক রকম, কিন্তু হাস্যরস প্রত্যেক জাতিরই কিছু না কিছু ভিন্ন প্রকৃতির। করুণ রসে মানুষ মানুষকে কাছে টানে, হাস্যরস আলাদা করে। তবু তিনটি হাস্যরসের গল্প দেওয়া হল; হয়তো পশ্চিম দেশবাসীরা সেগুলোতে আনন্দ পাবেন।
‘বিশ্বসাহিত্যের সেবা যেখানে উদ্দেশ্য, সেখানে সব চেয়ে ভাল। রচনা বাদ দেওয়া অন্যায়। কাজেই রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেওয়া চলে না। তার ‘লিপিকা’ থেকে তাই কয়েকটি সব চেয়ে ভাল লিখন দেওয়া হল; এগুলোকে ছোট ছোট গল্প বলা ভুল হবে।।(১) লেখাগুলো সহজেই দুভাগে আলাদা করা যায়, কতকগুলো মহাকাব্যের কাঠামোয় গড়া বলে গভীর সত্যের রূপ প্রকাশ করে তোলে, আর কতকগুলো ছবির মত কিসের যেন প্রতীক, কেমন যেন অস্বচ্ছ অর্ধ-অবগুষ্ঠিত অনাদি অনন্তের আস্বাদ দেয়, অথবা যেন নিগূঢ় আত্মার অন্তনিহিত কোমল নিশ্বাস আমাদের সর্বাঙ্গে স্পর্শ দিয়ে যায়।
সর্বশেষ যাঁরা তাঁদের লেখার অনুবার করবার অনুমতি দিয়েছেন তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, বিশেষ করে যাঁরা এই সঙ্কলনের গোড়াপত্তন ও সম্পূর্ণ করাতে সাহায্য করেছেন। সদুপদেশ দিয়েছেন ও অনুবাদে যাতে ভুলত্রুটি না থাকে তার জন্য আমি নিম্নলিখিত মহাশয়দের কাছে কৃতজ্ঞ,-হের দ. প. রায়চৌধুরী, ডি. ফিল. (গ্যোটিঙেন); ইঞ্জিনিয়র বিদ্যার্থী অ. ভাদুড়ী; য. চি. হুই, এম.এস-সি; যা ভবসু, ডি.ফিল, (বার্লিন) এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমাধারী স.চ. ভট্টাচার্য।(২) সুরসিক, বহু ভাষায় সুপণ্ডিত লাভ, রামস্বামী আইয়ার(৩) এম.এ.বি.এল. বেশির ভাগ মূল লেখাগুলি পাঠিয়েছেন ও সঙ্কলন আরম্ভ করার জন্য উৎসাহিত করে শেষ পর্যন্ত সাহায্য করেছেন। পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার জন্য গৃহিণীকে ধন্যবাদ।(৪)
অবতরণিকাটি নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা করা যায় কিন্তু আমার উদ্দেশ্য পাঠক যেন নিজেই ভাগনার সাহেবের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেন। আমার শুধু একটি বক্তব্য যে অবতরণিকার ভাষ্যটি সরল, যাঁরা মূল জর্মনে কনট হেগেল এমন কি টমাস মানও পড়েছেন তারাই জানেন জর্মনে কি রকম আড়াইগজী সব বাক্য হয়। ভাগনারের জর্মন অনেকটা বাংলা ছন্দের—কিছুটা প্রমথ চৌধুরীর মত। বাক্যগুলো ছোট ছোট; সাদামাটা খাস জর্মন কথার ব্যবহার বেশি কিন্তু দরকারমত শক্ত লাতিন কথা লাগাতে সায়েব পিছপা হন নি। জর্মন গুরুচণ্ডালীর সম্বন্ধে বাংলার মত ভয়ঙ্কর সচেতন নয়। বাগনার আবার সাধারণ জর্মনের চেয়েও অবচেতন।
পাঠকের সব চেয়ে জানার কৌতূহল হবে যে, কার কার লেখা বাগনার সাহেব নিয়েছেন। তার ফিরিস্তি দিচ্ছি :–
১। আমার দেশ (কবিতা) : শ্ৰীদ্বিজেন্দ্রলাল রায়(৪) (Schridvidschendralal Raj)
২। সন্ন্যাস : শ্ৰীযতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত (বিম্বদল)
৩। অঙ্কিত; গোলাপ; চোর; কুসুম; শিউলি : শ্ৰীহেমেন্দ্ৰকুমার রায় (সিঁদুর চুপড়ি, মধুপর্ক)
৪। দেবতার ক্ৰোধ; রত্নপ্ৰদীপ : শ্ৰীমণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় (আল্পনা ও জলছবি)
৫। পদ্মফুল; জন্ম-মৃত্যু শৃঙ্খল (আংশিক অনুদিত) : শ্ৰীমণীন্দ্রলাল বসু (মায়াপুরী)
৬। একাকী; প্রেমের প্রথম কলি : শ্ৰীনলিনীকান্ত ভট্টশালী (হাসি ও অশ্রু)
৭। বউ চোর, রসময়ীর রসিকতা : শ্ৰীপ্ৰভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (ষোড়শী, গল্পাঞ্জলি)
৮। গলি; পরীর পরিচয়; নূতন পুতুল; ছবি; সুয়োরানীর সাধ; সমাপ্তি; সমাধান; লক্ষ্যের দিকে; সূর্যস্ত ও সূর্যোদয়; পায়ে চলার পথ; কণ্ঠস্বর; প্রথম শোক; একটি দিবস; শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Schrirabindranath Thakur (লিপিকা)
৯। আঁধারে আলো : শ্ৰীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (মেজদিদি)
১০। পাষাণ হৃদয় : শ্ৰীমতী সুনীতি দেবী (বঙ্গবাণী)
এখনই বলে দেওয়া ভাল যে পুস্তকখানি প্রকাশিত হয়েছে ১৯২৬ সালে। তার মানে এই নয় যে, এই কজনই তখন নামজাদা লেখক ছিলেন। বরঞ্চ মনে হয়, ভাগনার। ১৯১২২০ এর সময় বাংলা শিখতে আরম্ভ করেন ও সে যুগে এঁদেরই যে খুব প্রতিপত্তি ছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে চারু বন্দ্যোপাধ্যায় যে কেন বাদ পড়লেন ঠিক বোঝা গেল না। অবশ্যি মনে রাখতে হবে যে, নির্বাচনটা ঠিক ভাগনারের হাতে ছিল না। এ দেশ থেকে যে সব বই পাঠানো হয়েছিল, তা থেকে ভাল হোক, মন্দ হোক তাঁকে বাছতে হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের নাম ভাগনার চলতি জর্মন কায়দায় ‘টেগোর’ লেখেন নি।
নানা টীকা-টিল্পনী করা যেত, কিন্তু সেটা পাঠকের কাছে ছেড়ে দেওয়াই ভাল। জর্মনমন এই গল্পগুলোতেই কেন সাড়া দিল, তার কারণ অনুসন্ধান তাঁরাই করুন।
সাধারণ জর্মনের পক্ষে দুর্বোধ্য কতকগুলো শব্দ পরিশিষ্টে দেওয়া হয়েছে; যেমন–অগ্নি (দেবতা), অলকা, অন্নপূর্ণ, আরতি, আষাঢ়, B.A. বেলপাতা, ভৈরবী রাগিণী, ভর্তৃহরি, ফুলশয্যা, চোরা বাগান, দোয়েল, জয়দেব যোগাসন, হাতের নোয়া, একতারা, হোলি, হুলুধ্বনি, কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাসের মহাভারত, মেদিনীপুর, শালিগ্রাম, সমুদ্রমন্থন, পয়সা, পানি কৌড়ি, রজনীগন্ধা, রাসলীলা, সাহানা, শুভদৃষ্টি, রথযাত্রা, ব্রাহ্ম সমাজ, ইংরেজি, উড়িয়া বামুন।