আর রাইনের ওয়াইনের প্রশংসা করার দায় তো আমার উপর নয়। ফ্রান্সের বর্দো বাগেন্ডির সঙ্গে সে কঁধ মিলিয়ে চলে।
আমি যখন প্রথম দিন আমার অধ্যাপকের সঙ্গে লেখাপড়া সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলুম, তখন তিনি ভুরি-ডুরি খাঁটি তত্ত্বকথা বলার পর বললেনঃ
‘এখানে ফুল প্রচুর পরিমাণে ফোটে, তরুণীরা সহৃদয়া এবং ওয়াইন সস্তা। বুঝতে পারছেন, আজ পর্যন্ত আমার কোনো শিষ্যেরই বদনাম হয় নি যে নিছক পড়াশুনো করে সে স্বাস্থ্যভঙ্গ করেছে। আপনিই বা কেন করতে যাবেন?’ রাজধানী ঠিক মোকামেই থানা গাড়লো!
—–
* হালে খবর পেয়েছি। তিনি রুশদেশে গিয়ে সেখান থেকে রামায়ণের প্রামাণিক পাঠ প্ৰকাশ করেছেন।
বর্বর জর্মন
ন্যুরিনবের্গের মকদ্দমা এগিয়ে চলেছে, চতুর্দিকে আটঘটি বেঁধে তরিবত করে তামাম দুনিয়ায় ঢাকঢোল বাজিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ওঃ, কী বাঁচনটাই না বেঁচে গেছে! এয়সা দুশমনের জাত যদি লড়াই জিতত, তা হলে তোমাদের দমটি পর্যন্ত ফেলতে দিত না। ভাগ্যিস আমরা ছিলাম, বাঁচিয়ে দিলাম।
বিলেতী কাগজগুলো যে দাপাদাপি করে, তাতে আশ্চর্য হবার বিশেষ কিছু নেই। তারা মার খেয়েছে, এখন শুধুমার দিয়েই খুশি হবে না, হরেক রকমে দুশমনকে অপমান করবে, তাতে ডবল সুখ; সে-সব কথা সবাইকেইনিয়ে-বিনিয়ে শোনাবে, তাতে তেহই সুখ; তারপর দেশটার কলকব্জা অর্থাৎ তার জিগর-কলিজা, নাড়িভূড়ি বিনা ক্লোরফর্মে টেনে টেনে বের করে তাকে আচ্ছা করে বুঝিয়ে দেবে, বেলজেন কাকে বলে।
কিন্তু এ দেশের ইংরেজি কাগজগুলো যখন ফেউ লাগে, তখন আর বরদাস্ত হয় না। ছিলি তো বাবা যুদ্ধের বাজারে বেশ, না হয়। স্কচ না খেয়ে সোলান খেয়েছিস, না হয় এসপেরেগাস আরটিচোক খেতে পাস নি, না হয় তুলতুলে ফ্ল্যানেল আর নানা রকমের হ্যাট ও ক্যাপ পাস নি বলে সর্দি ও গর্মির ভয়ে একটুখানি পা সামলে চলেছিলি, তাই বলে যা বুঝিস নে, মালুম নেই, তা নিয়ে এত চেন্নাচেল্লি করিস কেন? টু পাইস তো করেছিস, সে কথাটা ভুলে যাস কেন, তাই নিয়ে দেশে যা, দুদিন ফুর্তি কর, যে জায়গা নাগাল পাস নে, সেখানে চুলকোতে যাস নি। কিন্তু শোনে কে! সেই জিগির-জার্মান বর্বর, ‘বশ’, ‘হান’।
পরশুদিন জর্মন বর্বরতার প্রমাণ পেলুম, পুরনো বইয়ের দোকানে—একখানা কেতাব, আজকালকার জলের চেয়েও সস্তা দরে কিনলাম। তার নামধাম
BENGASCHE ERZAEHLER / DER SEG DEFR SEELE / AUS DEM INDISCEHN / INS DEUTSCH UEEERTAGEN / VONIRENHAR)T WAGNER /
অর্থাৎ ‘বাঙালি কথক’। (Enzaehler ধাতুর অর্থ কাহিনী বলা) ‘আত্মার জয়, ভারতীয় ভাষা হইতে জর্মনে রাইনহার্ট ভাগনার কর্তৃক অনুদিত।’
চমৎকার লাল মলাটের উপর সোনালী লাইনে একটি অজন্তা ঢঙের সুন্দরী বাঁশি। বাজাচ্ছে। ছবিখানি এঁকেছেন, কেউ-কেটা নয়, স্বয়ং অধ্যাপক এডমুনডশেফার।
কেতাবখানা যত্রতত্র বিক্রির জন্য পাওয়া যাবে না-এস্তেহার রয়েছে। ‘ব্যুশারফ্রয়েন্ডে’ সংঘের সভ্যরা কিনতে পাবেন। বর্বর জর্মন বটতলা ছাপিয়ে, পেঙ্গুইন বেচে পয়সা করতে চায় না, তার বিশ্বাস-দেশে যথেষ্ট সত্যিকারের রসিক পাঠক আছে, তারা সংঘের সদস্য হয়ে বাছা বাছা বই কিনবে। আর যদি তেমনটা নাই হয়, হল না, চুকে গেল-বাংলা কথা।
‘বাংলা কথা।’ ইচ্ছে করেই বললাম, কারণ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ভাগনার সাহেব খাসা বাংলা জানেন। প্রথম আলাপে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মহাশয় কোন ভাষার অধ্যাপক?
বাংলার।
বাংলার? বার্লিন ইউনিভার্সিটিতে?
আজ্ঞে।
ছাত্ৰ কটি?
গেল পাঁচবছরের হিসেব নিলে গড়পড়তা ৩/৫।
গর্বে আমার বুক ফুলে উঠল। আমি যে ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি, সেখানে ফি ক্লাসে নিদেনপক্ষে দেড়শটা বোদর ঝামেলা লাগাত। আদর্শ ছিল-৩০০ আপিন ওয়ান প্রফেসারের। বললাম, ৩/৫ একটু কম নয়?
ভাগনার বিরক্ত হয়ে বললেন, রবিবাবুর লেখা পড়েন নি।–The rose which is single need not envy the thorns which are many?
উঠে গিয়ে ধনধান্যে পুষ্পে ভরা রেকর্ডখানি লাগালেন। ভাব হয়ে গেল। কিন্তু মনে মনে বললাম, কুল্লে ৩/৫-এর জন্যে একটা আস্ত প্রফেসার। জর্মনরা বর্বর।
অবতরণিকাটি ভাগনার সাহেব নিজেই লিখেছেন; আগাগোড়া তৰ্জমা করে দিলুম।
‘সঙ্কলনটি আরম্ভ স্বৰ্গীয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত জাতীয় সঙ্গীত দিয়ে। অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ গদ্য রচনাগুলোকে বাংলার (tschota gallpa (ছোট গল্প) বলা হয়। ছোট গল্পগুলোকে এক রকমের ছোটখাটো উপন্যাস বলা যেতে পারে; শুধু নায়ক-নায়িকার সংখ্যা কম। গল্পগুলোর কাঠামো পশ্চিম থেকে নেওয়া হয়েছে, ভিতরকার প্রাণবস্তু কিন্তু খাঁটি ভারতীয়। মাঝে মাঝে দেখা যায় সমস্ত গল্পটার আবহাওয়া একটিমাত্র মূল সুরের চতুর্দিকে গড়া। কতকগুলো আবার গীতিরসে ভেজানো। আবার এও দেখা যায়, ভারতবাসীর ধর্ম তার আচার-ব্যবহারের সঙ্গে এমনই বাধা যে গল্পের বিকাশ ও সমস্যা সমাধান এমন সব কারণের উপর নির্ভর করে, যেগুলো পশ্চিমে নভোলে থাকে না। আশা-নিরাশার দোলাখাওয়া কাতর হৃদয় এই সব গল্প। কখনও বা ধর্মের কঠিন কঠোর আচারের সঙ্গে আঘাত খেয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে, কখনও বা তার ছোট গণ্ডির ভিতর শান্তি খুঁজে পায়; সেই ধুকধুক হৃদয়ের কঠোর দুঃখ, চরম শাস্তির বর্ণনা করা হয়েছে গভীর অন্তদৃষ্টি দিয়ে। আন্দ্রেয়াস হয়েসলারের সঙ্গে আমরা সুর মিলিয়ে বলতে পারি, “মানুষের আত্মার ভাঁজে যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি।“