ফুটবল ভাষায় একটি তীব্র ‘সট’–এর (‘Sot’-shot নয়) ফলে গোলটি হল।
পিছনের সর্দারাজী বললেন, ‘ইয়ে গোল বাচানা মুশকিল। নহী থা।’
আমি মনে মনে বললুম, ‘সাহিত্যে একে আমরা বলি, ‘মুখবন্ধ’। এরপর আরো গোটা দুই হলে তোমার মুখ বন্ধ হবে। লোকটা জোরালো না হলে—।’
***
এ সব ভাবাভাবির পূর্বেই আরেকখানা সরেস গোল হয়ে গিয়েছে। কেউ দেখল, কেউ না। একদম বেমালুম। তারই ধকল কাটাতে কাটাতে আরেকখানা, তিসরা অতিশয় মান-মনোহর গোল! সেটি স্পষ্ট দেখতে পেলুম। ও গোল কেউ বঁচাতে পারত না। দশটা গোলি লাগিয়ে দিলেও না।
এবার ম্যানেজারকে অভিনন্দন জানানো যেতে পারে। উঠে গিয়ে তাকে জোর শ্যাকহ্যান্ড করলুম। ভারী খুশি। আমায় বললে, ‘প্ৰত্যেক গোলে আপনার রি-একশন লক্ষ্য করছিলাম। আমরা আমাদের কথা রেখেছি (অর্থাৎ ফাইন্যালে উঠেছি)। আর আপনিও আপনার কথা রেখেছেন (আমি কথা দিয়েছিলুম ওরা ফাইনালে জিতবেই)।’ তার সঙ্গী তো আমার হাতখানা কপালে ঠেকালে।
মোরগ যে রকম গটগট করে গোবরের টিবিতে ওঠে। আমি তেমনি আমার চেয়ারে ফিরে এলুম। ভাবখানা, তিনটে গোলই যেন নিতান্ত আমিই দিয়েছি।
তারপর শাঁ করে আরো একখানা। দশ-বারো মিনিটের ভিতর ধনাধন চারখানা আদি ও অকৃত্রিম, খাঁটি-নিৰ্ভেজাল গোল!
পিছনের সর্দারাজী চুপ।
চ্যালাকে বললুম, চলো বাড়ি যাই। খেলা কি করে জিততে হয়, হাতে-কলমে দেখিয়ে দিলুম তো!’
রাত্রে সব খেলোয়াড়দের অভিনন্দন জানাতে গেলুম। গিয়ে দেখি এক ঢাউস ট্রফি। সঙ্গে আরেকটা বাচ্চা। বললুম, ‘বাচ্চাটাই ভালো। বড়টা রাখা শক্ত (উভয়ার্থে)।’
ওদেরই বিস্তর নাইন-নাইন্টি পুড়িয়ে বাড়ি ফিরলুম।
বন
পশ্চিম-জার্মনীর রাজধানী বনবাসী হতে চলেছেন শুনে পাঠক যেন বিচলিত না হন। এ ‘বনে’র উচ্চারণ ‘ঘরে’র মত। বাংলা উচ্চারণের অলিখিত আইন অনুযায়ী ‘ন’ অথবা ‘ণ’ পরে থাকিলে একমাত্রিক শব্দে ‘অ’–কারটি ‘ও’–কারে পরিণত হয়। যথা-মন , বনউচ্চারিত হয় মোন বোন-ইত্যাদি রূপে। কিন্তু এই জর্মন Bonn শব্দের উচ্চারণে ‘ব’য়ের স্বরবর্ণটি ঘরের অ-কারের মত উচ্চারিত হয়। তাই পরাধীন জর্মনী আজ বনে রাজধানী পেয়ে যেন ঘর পেয়েছে একথা অনায়াসে বলা যায়।
কাগজে বেরিয়েছে বনের লোকসংখ্যা এক লক্ষ। আমাদের দেশে যেমন বলা হয়, পাঁচ বৎসর লালন করবে, দশ বৎসর তাড়না করবে এবং ষোড়শবর্ষে পদার্পণ করলে পুত্রের সঙ্গে মিত্রের ন্যায় আচরণ করবে, জর্মনীতে ঠিক তেমনি আইন, কোনো শহরের লোকসংখ্যা যদি একলক্ষে পৌঁছে যায়। তবে তিনি সাবালক হয়ে গেলেন, তাকে তখন ‘গ্রোস-স্টান্টু’ বা বিরাট নগররূপে আদর-কদর করে বার্লিন মুনিক কলোন হামবুর্গের সঙ্গে একাসনে বসাতে হবে। অর্থাৎ মার্কিন ইংরেজ কর্তাদের মতে বন বিরাট নগর এবং জর্মনীর রাজধানী তারা বিরাট নগরেই স্থাপনা করেছেন।
কিন্তু এই কেঁদে ককিয়ে টায়ে-টায়ে এক-লক্ষী শহরেই রাজধানী কেন করতে হল? আমি বন শহরে বহু কর্মক্লান্ত দিবস এবং ততোধিক বিনিদ্র যামিনী যাপন করেছি। বনের হাড়হদ আমি বিলক্ষণ জানি। তার লোকসংখ্যা কি কৌশলে ১৯৩৮ সালে এক লক্ষ করা হয়েছিল সেও আমার অজানা নয়। একলক্ষী হয়ে সাবালকত্ব পাবার জন্য বন কায়দা করে পাশের একখানা গ্রামকে আদমশুমারীর সময় আপন কণ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিল-যদিও সে গ্রামটি বনের উপকণ্ঠে অবস্থিত নয়, দুয়ের মাঝখানে বিস্তর যাব-গমের তেপান্তরী ক্ষেত।
আসল তত্ত্ব হচ্ছে বন রুশ সীমান্ত থেকে অনেক দূরে। মার্কিন ইংরেজ ধরে নিয়েছে আসছে লড়াই-এ জর্মনী রুশের বিরুদ্ধে লড়বে এবং তখন রাজধানী যদি রুশ সীমাস্তের কাছে থাকে, তবে তাতে মেলা অসুবিধা—প্যারিস ফ্রান্সের উত্তর সীমাস্তে থাকায় তাকে যেমন প্রতিবারেই মার খেতে হয়, বেড়ালের মত রাজধারনীর বাচ্চা নিয়ে কখনো লিয়োঁ কখনো ভিশিময় ঘুরে বেড়াতে হয়।
কিন্তু বনে রাজধানী নির্মাণে আরেকটি মারাত্মক তথ্য আবিষ্কৃত হয়ে গেল। বেলজিয়াম যে রকম প্রতিবার জর্মনীকে ঠেকাতে গিয়ে বেধড়ক মার খেয়েছে, এবার জর্মনী রুশকে ঠেকাতে গিয়ে সেইরকম ধারাই মার খাবে। বার্লিন গেছে, ফ্রাঙ্কফুর্ট যাবে, বনও বাঁচবে না।
কিন্তু থাক এসব রসকষহীন রাজনীতি চর্চা। বরঞ্চ এসো সহ্যদয় পাঠক, তোমাকে বনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।
এপারে বন, ওপারে সিবেন গেবিৰ্গে’ অর্থাৎ সপ্তশ্ৰীলাচল। মাঝখানে রাইন নদী। সে নদীর বুকের উপর দিয়ে জাহাজ চড়ার জন্য প্রতি বৎসর লক্ষ লক্ষ লোক তামাম ইউরোপ আমেরিকা থেকে জড়ো হয়। নদীটি একে বেঁকে গিয়েছে, দুদিকে সমতল জমির উপর গম-যবের ক্ষেত, মাঝে মাঝে ছবির মত ঝকঝকে তকতকে ছোট্ট ছোট্ট ঘরবাড়ি, সমতল জমির পিছনে দু সারি পাহাড় নদীর সঙ্গে সঙ্গে এঁকে বেঁকে চলে গিয়েছে-মেঘমাশ্লিষ্টসানুং।
আর বন শহরের ভিতরটাও বড় মনোরম। বার্লিনের মত চওড়া রাস্তা নেই, পাচতলা বাড়িও নেই। মোটরের গোক-গাঁকিও নেই। আছে কাশী আগ্রার মত ছোট ছোট গলিখুঁচি, ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি-ঘর-দোর, ঘুমস্ত কাফে, অর্ধ-জাগ্রত রেস্তোরাঁ। আর বিশাল বিরাটবিপুল কলেবর আধখানা শহর জুড়ে ভুবনবিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই জর্মনীতে প্রথম সংস্কৃত চর্চা আরম্ভ হয়। হেরমান য়াকোবি এখানেই অধ্যাপক ছিলেন। তার শিষ্য কিফেল এখনো সেখানে সংস্কৃত পড়ান। পুরাণ সম্বন্ধে তাঁর মোটা কেতাবখানার তর্জমা ইংরেজিতে এখনো হয় নি। কিফেলের সতীর্থ অধ্যাপক লশ উপনিষদ নিয়ে বছর বিশেক ধরে পড়ে আছেন। তার সুহৃদ রুবেনসের শরীরে ঈষৎ ইহুদি রক্ত ছিল বলে তিনি জর্মনী ছাড়তে বাধ্য হন। উপস্থিত তিনি তুর্কীর আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত পড়ান। বহুকাল ধরে রামায়ণখানা কামড়ে ধরে পড়ে আছেন—প্রমাণিক পুস্তক লেখবার বাসনায়।*