সায়েব : সে কথা থাকুক (ধুয়া)।
ভারতীয় : হ্যাঁ, আলোচনাটাই আমার পক্ষেও মর্মঘাতী। আমারি এক বাঙালি খ্রিস্টান বন্ধু কাঁটা দিয়া ইলিশ মাছ খাইতে যান—বেজায় সায়েব কিনা-ফলে ইলিশাস্থি তাহার গলাস্থ হয় এমনি বেকায়দা বেদুরস্তভাবে যে, তাহার শরীরের অস্থিগুলি এখন গোরস্তানে চিরতের বস্তি গাড়িয়াছে (অশ্রু বর্ষণ)।
সায়েব : আহা! তবে ইলিশ না খাইলেই হয়।
ভারতীয় : ইংরাজ হইয়া বেকান-আন্ডা না খাইলেই হয়; ফরাসি হইয়া শ্যাম্পেন না। খাইলেই হয়; জর্মন হইয়া সসিজ না খাইলেই হয়; বাঙালি হইয়া ইলিশ না খাইলেই হয়, অনশনে প্ৰাণত্যাগ করিলেও হয়; আত্মহত্যা করিলেও হয়। লাজ করে না বলিতে? বাংলার বুকের উপর বসিয়া হোম হইতে টিনস্থ বেকন না পাইলে ব্রিটিশ ট্রেডিশন ইন ডেঞ্জার বলিয়া কমিশন বসাইতে চাহো, আর আমি গঙ্গার পারে বসিয়া গঙ্গার ইলিশ খাইব না? তাজ্জব কথা!
সায়েব : সে কথা থাকুক (ধুয়া)। কিন্তু ঐ বলিলে তোমাদের মেয়েরা রান্না করেন, র্তাহারা কি শুধুই রান্না করেন? তাহারা এই নির্মম পর্দা প্ৰথা মানেন কেন?
ভারতীয় : সে তাহারা মানেন; তাহাদিগের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিও।
সায়েব : তাহাদিগের সঙ্গে তো দেখাই হয় না।
ভারতীয় : সে আমাদের পরম সৌভাগ্য।
সায়েব : (চিন্তিত মনে) কথাটা কি একটু কড়া হইল না? আমরা কি এতই খারাপ?
ভারতীয় : খারাপ ভালোর কথা জানিনা সাহেব। তবে ১৭৫৭ সালে তোমাদের সাথে পীরিতিসায়রে সিনান করিতে গিয়া শুধু যে আমাদের সকলি গরল ভেল। তাহা নয়, স্বরাজগামছাখানা হারাইয়া ফেলিয়া দুইশত শীত বৎসর ধরিয়া আকণ্ঠ দৈন্য-দুৰ্দশ-পঙ্কে নিমগ্ন-ডাঙ্গায় উঠিবার উপায় নাই। পুরুষদের তো এই অবস্থা। তাই মেয়েরা অন্তরমহলে তোমাদিগকে quit করিয়া বসিয়া আছেন।
সায়েব : এ সব তো বাইরের কথা; তোমাদের কৃষ্টি, ঐতিহ্য—
ভারতীয় : আরেকদিন হইবে। উপস্থিত আমাকে Quit India গাহিতে রাস্তায় যাইতে হইবে।
(ডিসেম্বর ১৯৪৫)
ইন্দ্ৰলুপ্ত
(আবু সাঈদ আইয়ুবকে)
ঘরের দাওয়ায়, তেঁতুলের ছাওয়ায়, মাঠের হাওয়ায়
খাওয়া-দাওয়ায়
শান্তি নেই, গরমেরও ক্লান্তি নেই।
সবুজ ঘাস হল হলদে, তারপর ফিকে।
দস্যি কাল-বোশেখী বাঁশের বনে ত্রিবিক্রমে বিক্রমে
তাদের কোমর ভেঙে নামল মাঠে।
লাথি মেরে বেঁটিয়ে নিয়ে গেল তার শুকনো শেকড়
বেরিয়ে পড়ল শুভ্ৰ, উন্ম, নগ্ন মৃত্তিকা।
মাঠের টাক–
আমার টাকের মতো।
কলনের ঘন বনে
নিদাঘের তপ্ত কাফে কোণে
তুমি বসে আনমনে
—আমার চুলের ঘুঙুর তোমার নাচাল নয়ন নীল
কালোকে নীলোতে নাৎসি হারাতে পেল কি গোপন মিল?–
রাইনের ওয়াইনের মৃদু গন্ধ,
একচোখা রেডিয়োটা করে কটমট
ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘ফ্রল্যান, Gruless Gott!
বেতারের সুরাটা টাঙ্গো না ফক্স-স্ট্রট?’
চট করে চটে যাও পাছে!
তুমি রূপসিনী বন্দিনী
নরদেশী নন্দিনী।
তোমার প্রেম এল যে
শ্রাবণের বর্ষণের ধারা নিয়ে
চারদিকে টেনে দিয়ে
ঘনকৃষ্ণ সজল যামিনী যাননিকা।
সে বিরাট বিলুপ্তির বিস্মরণে
শুধু আমার চেতনার ছয় ঋতু
আর তোমার চেতনার চার ঋতুর বিজড়িত নিবিড় স্পৰ্শ–
লাল ঠোঁট দিয়া বঁধূয়া আমার
পড়িল মন্ত্র কাল
দেহলি রুধিয়া হিয়ারে বান্ধিল
পাতিয়া দেহের জাল।
মুখে মুখ দিয়া হিয়ায় হিয়ায়
পরশে পরশে রাখি
বাহু বাহুপাশে ঘন ঘন শ্বাসে
দেহে দেহ দিল ঢাকি।
হঠাৎ দামিনী ধমকালো
বিদ্যুৎ চমকালো
দেখি, নীল চোখ
কাতরে শুধাই একি
তোমার নয়নে দেখি,
তোমার দেশের নীলাভ আকাশ
মায়া রচিছে কি?
তোমার বক্ষতলে
আমার দেশের শ্বেতপদ্ম কি
ফুটিল লক্ষ দলে?
রাত পোহালি। বর্ষণ থেমেছে।
কিন্তু কোথায় শরতের শান্তি, হেমন্তের পূর্ণতা?
ঋতুচক্ৰ গেল উলটে–
যমুনার জলও একদিন উজান বয়েছিল।–
কোন ঝড় তোমাকে নিয়ে গেল ছিনিয়ে
কোন ঝড় আমাকে নিয়ে গেল ঝেঁটিয়ে?
বেরিয়ে এল মাঠের টাক,
আমার টাকা।
আমার জীবনে ইন্দু লুপ্ত
আমার কপালে ইন্দ্রলুপ্ত।।
উপেন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়–নির্বাসিতের আত্মকথা
কোনো কোনো বই পড়ে লেখকেরা আপন আপন ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বড় নিরাশ হন। যাদের সত্যকার শক্তি আছে, তাদের কথা হচ্ছে না, আমি ভাবছি আমার আর আমার মত আর পাঁচজন কমজোর লেখকের কথা।
প্রায় ত্রিশ বৎসর পর পুনরায় ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’ পুস্তিকাখনি আদ্যন্ত পড়লুম। পাঠকমাত্রই জানেন, ছেলেবেলার পড়া বই পরিণত বয়সে পড়ে মানুষ সাধারণত হতাশ হয়। নির্বাসিতের’ বেলা আমার হল বিপরীত অনুভূতি, বুঝতে পারলুম, কত সূক্ষ্ম অনুভূতি, কত মধুর বাক্যভঙ্গি, কত উজ্জ্বল রসবোক্য, কত করুণ ঘটনার ব্যঞ্জনা তখন চোখে পড়ে। সাধুভাষার মাধ্যমে যে এত ঝকঝকে বর্ণনা করা যায়, সে ভাষাকে যে এতখানি চটুল গতি দিতে পারা যায়, ‘নির্বাসিত’ যারা পড়েন নি, তারা কল্পনামাত্র করতে পারবেন না।
কিন্তু প্রশ্ন, এই বই পড়ে আপন ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হতাশ হলুম কেন?
হয়, এ রকম একখানা মণির খনির মত বইয়ের চারিটি সংস্করণ হল ত্ৰিশ বৎসরে! তাহলে আর আমাদের ভরসা রইল কোথায়?
***
১৯২১ (দু-চার বছর এদিক-ওদিক হতে পারে) ইংরেজিতে একদিন শান্তিনিকেতনে লাইব্রেরিতে দেখি একগাদা বই গুরুদেবের কাছ থেকে লাইব্রেরিতে ভর্তি হতে এসেছে। গুরুদেব প্রতি মেলে বহু ভাষায় বিস্তর পুস্তক পেতেন। তার পড়া হয়ে গেলে তার অধিকাংশ বিশ্বভারতীর পুস্তকাগারে স্থান পেত। সেই গাদার ভিতর দেখি, ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’।