‘আপনাকে কি বলবো, তারপর সেদিন ক্লাসে বসে যখনই আড়নয়নে তাকিয়েছি তখনই দেখেছি, সে চোখ বন্ধ করে আছে, তার ঠোঁটের কোণে গভীর প্রশস্তির মৃদু হাস্য, আর গালের আপেল দুটো খুশিতে উপরের দিকে উঠে চোখ দুটো যেন চেপে ধরেছে। আমি তো ভয়ে মরি, মুখটা আবার কি বলতে গিয়ে কি না বলে ফেলে।
‘তার পর দিন থেকে আরম্ভ হল আরকে আজব কেচ্ছা। ছেলেরা রুটিনমাফিক তাকে ‘ব্যা-ড’ বললে, চুলে ধরে টান দিলে, অন্যান্য প্রকরণেরও কোনো খাঁকতি হল না। কিন্তু সেও রুটিনমাফিক চিৎকার চেচামেচি গালাগাল দিলে না-সে দেখি, চোখ বন্ধ করে মিটমিটিয়ে হাসছে—আমি ভাবলুম, হয়েছে, ছোঁড়াটা বোধ করি ক্ষেপে গেছে।
‘বহু পরে সে আমাকে একদিন বলেছিল, এ নাকি তখন খুশিতে ডগোমগো, তার নাকি ভারী আনন্দ, তার আর কি ভয়, এই ক্লাসেই তার একটি বন্ধু রয়েছে, সে তাকে চকলেট খাইয়েছে।’
আমি বললুম, ‘অতিশয় হক কথা! ফার্সীতে প্রবাদ আছে—
‘দুশমন্ চি কুনদ্, আগর, মেহেরবান বাশাদ দোস্ত!’
“দুশ্মন কি করতে পারে, দোস্ত যদি মেহেরবান্ হয়!”’
নয়রাট উল্লসিত হয়ে ফ্রানৎসিসককে বললেন, ‘বউ, প্রবাদটা টুকে নাও তো, কাউকে দিয়ে পাসীতে লিখিয়ে নিজে জর্মনে গথিক হরফে তর্জমা লিখে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখবো।’
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এতদিন ধরে আমি জুতসই একটা প্রবাদের সন্ধানে ছিলুম-আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
তারপর বললেন, ‘ছোঁড়াটা অদ্ভুত। আমাকে বিপদে না ফেলার জন্য আমার কাছে এসে ন্যাওটামি করতো না। একলা-একিলি দেখা হলে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করত।
‘তার কয়েকদিন পরে আমার জন্মদিন। ক্লাসের ছোঁড়াগুলোর প্রতি যদিও আমি ঐ ছোকরাটাকে জ্বালাতন করার জন্য বিরক্ত হাতুম। তবু অন্য বাবদে ওরাই তো আমার সঙ্গী; তাই তাদের নেমন্তন্ন করলুম, আর না করলে মা-ই বা কী ভাববে? তারা আমার জন্য উপহার আনলে বই, পেন্সিল, চুরি, কলের লাটিম এবং আর পাঁচটা জিনিস। আমরা কেক লেমনেড খাচ্ছি, জোর হৈ-হুল্লোড় চলছে, এমন সময় বাড়ির দাসী আমার কানে কানে বললে, ‘ছোটবাবু, তোমার জন্য একটি ছেলে নিচের তলায় পেটে দাঁড়িয়ে। কিছুতেই উপরে আসতে চায় না; তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে।’
‘আমার সব বন্ধুই তো গটগট করে উপরে আসে। এ আবার কে?
‘গিয়ে দেখি সেই পাগলা। হাতে এক ঢাউস বাক্স। লাজায় লাল হয়ে বললে’–তোর জন্মদিনে একটা প্রেজেন্ট এনেছি। ছোট্ট একটা পাল-লাগানো ইয়ট।’
‘বলে কি? ‘ইয়ট’ তখন আমাদের স্বপ্নের বাইরে। পুরো বছরের জলখাবারের পয়সা জমালেও আমাদের ক্লাসের ধনী ছোকরা আডলফ পর্যন্ত ইয়ট’ কিনতে পারে না—তখনো জানতুম না, সে পয়সাওলা ছেলে।
‘লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। বললুম, ‘তুই উপরে চ, কেক খাবি।’
‘বললে, ‘না, ভাই, তুই যা, উপরে আরো অনেক সব রয়েছে।’’
‘আমি তাকে জোর করে উপরে টেনে নিয়ে এলুম। কোখোকে সাহস পেলুম আজো জানি নে। বোধ হয় ইয়টের কৃতজ্ঞতায়।’
আমি থাকতে না পেরে বললুম, ‘ছিঃ’, জিনিস নিয়ে ঠাট্টা করবেন না।’
নয়রাট বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ। তার পর উপরে কি হল ঠিক বলতে পারব না। প্রথমটায় সবাই থ মেরে গেল। তারপর একে একে সক্কিলেই পাগলার সঙ্গে শেক-হ্যান্ড করলে। তার চোখ দিয়ে আবার সেই পয়লা দিনের মতো ঝরঝর করে জল নেমে এল।
‘সেই দিনই আমি মনস্থির করলুম, বড় হলে আমি সর্বত্র এরকম ছেলেদের অন্যায় অত্যাচার থেকে বাঁচাবো। ভগবান আমাকে আজ দেখিয়ে দিয়েছেন, এ শক্তি আমার ভিতর আছে।’
নয়রাট হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বললেন, ‘এখখুনি আসছি; আমি একটা টেলিফোন করতে ভুলে গিয়েছিলুম।’
বুঝলুম, বিনয়ী লোক, লজ্জা ঢাকবার অবকাশ খুঁজছেন।
—————–
(১) শব্দটা গ্ৰাম্য; কিন্তু পূজনীয় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অভিধানে শব্দটিকে অবহেলা করেন নি বলে আমি ড্যাস দিয়ে সারলুম। তিনি গুরুজন—ৰ্তার শাস্ত্ৰাধিকার আছে।
(২) ‘নেমকহারাম’ অর্থাৎ ‘অকৃতজ্ঞ, সমাসটা বাংলায় চলে। ‘নেমকহালাল’ ঠিক তার উল্টো অর্থাৎ ‘কৃতজ্ঞ’। ‘নেমকহারাম’ ‘নেমকহালাল’ কথাগুলা কিন্তু ‘কৃতজ্ঞ’ ‘অকৃতজ্ঞের চেয়ে জোরদার। নিমক’ = ‘নুন’-তার অপমান’ (হারাম) কিম্বা সম্মান’ (হালাল)।
(৩) পঞ্চতন্ত্র ১ম পর্ব দ্রষ্টব্য
(৪) সুফীরা মদ্য ‘ভগবদ-প্রেম’ অর্থে ব্যাখ্যা করেন।
(৫) ‘রুবাই’ একবচন, ‘রুবাইয়াৎ’ বহুবচন।
পরিমল রায়
পরিমল রায়ের অকালমৃত্যুতে কেউ সখা, কেউ গুরু, কেউ সহকর্মী, কেউ প্রতিবেশী এবং দিল্লি শহর একটি উৎকৃষ্ট নাগরিক থেকে বঞ্চিত হল।(১) মৃত্যুকালে পরিমল রায় নিউইয়র্কে ছিলেন। কিন্তু এ আশা সকলেই মনে মনে পোষণ করতেন যে আমেরিকায় বহু প্রকারের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তিনি আবার দিল্লিতেই ফিরে আসবেন এবং তার বন্ধুবান্ধব, তার শিষ্যমণ্ডলী তথা বাংলা সাহিত্যুমোদীজন তাঁর সে অভিজ্ঞতার ফল লাভ করতে সক্ষম হবেন।
পরিমল রায় সত্যই নানা গুণের আধার ছিলেন।
একদা ‘মৌলানা খাকী খান’ আমাকে একটি ক্ষুদ্র বিতর্ক-সভাতে নিয়ে যান। সে সভাতে পরিমল রায় ভারতবর্ষে কি প্রকারে কলকব্জা কারখানা ফ্যাক্টরি তৈরি করার জন্য পুঁজি সংগ্ৰহ করা যেতে পারে, সে সম্বন্ধে আলোচনা করেন। এরকম আলোচনা আমি জীবনে কমই শুনেছি। পরিমল রায় জানতেন, তার শ্রোতারা অর্থনীতি বাবদে এক একটি আস্ত বিদ্যাসাগর’; তাই তিনি এমন সরল এবং প্রাঞ্জল ভাষায় মূল বক্তব্যটি বলে গেলেন যে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য এবং সে পণ্ডিত্যকে অজ্ঞজনের সামনে নিতান্ত স্বতঃসিদ্ধ দৈনন্দিন সত্যরূপে প্রকাশ করার লৌকিক পদ্ধতি দেখে আমি মুগ্ধ হলুম। তাঁর ভাষণ শেষ হলে আমি দু-একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলুম। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি বাঘা পণ্ডিতের মত খেঁকিয়ে উঠলেন না। অতিশয় সবিনয়ে তিনি আমার দ্বিধাগুলোকে এক লহমায় সরিয়ে দিলেন। আমার আর শ্রদ্ধার অন্ত রইল না। পণ্ডিতজনের বিনয় মুখের চিত্তজয় করতে সদাই সক্ষম।