এই নিন একটি ছোট ঘটনা। প্রথম পশ্চিম বাঙলার সংস্করণটি দিচ্ছি। এক পয়সার তেল কিনে ঘরে এনে বুড়ি দেখে তাতে একটা মরা মাছি। দোকানিকে গিয়ে অনুযোগ জানাতে সে বললে, এক পয়সার তেলে কী তুমি মরা হাতি আশা করেছিলে! এর রাশান সংস্করণটি আরও একটু কাঁচা। এক কপেকের (প্রায় এক পয়সা) রুটি কিনে এনে ছিঁড়ে দেখে এক বুড়ি তাতে একটুকরো ন্যাকড়া। দোকানিকে অনুযোগ করাতে সে বললে, এক কপেকের রুটির ভিতর কী তুমি আস্ত একখানা হীরের টুকরো আশা করেছিলে? এর ইংরিজি সংস্করণ আছে, এক ইংরেজ রমণী এক শিলিঙে একজোড়া মোজা কিনে এনে বাড়িতে দেখেন তাতে একটি ল্যাডার (অর্থাৎ মই– মোজার একটি টানা সুতো ছিঁড়ে গেলে পড়েনের সুতো একটার পর একটা যেন মইয়ের এক-একটা ধাপ-কাঠির মতো দেখায় বলে এর নাম ল্যাডার।) দোকানিকে অনুযোগ জানাতে সে বললে, এক শিলিঙের মোজাতে কি আপনি, ম্যাডাম, একখানা রাজকীয় মার্বেল স্টেয়ার কে আশা করেছিলেন!
এবারে সর্বশেষ শুনুন কুট্টি সংস্করণ। সে একখানা ঝুরঝুরে বাড়ি ভাড়া দিয়েছে পুলিশের এসআইকে। বর্ষাকালে কুট্রিকে ডেকে নিয়ে তিনি দেখাচ্ছেন, এখানে জল ঝরছে, ওখানে জল পড়ছে– জল জল সর্বত্র জল পড়ছে। পুলিশের লোক বলে কুট্টি সাহস করে কোনও মন্তব্য বা টিপ্পনী কাটতে পারছে না, যদিও প্রতি মুহূর্তেই মাথায় খেলছে বিস্তর। শেষটায় না থাকতে পেরে বেরুবার সময় বললে, ভাড়া তো দ্যা কুল্লে পাঁচটি টাকা। পানি পড়বে না তো কি শরবত পড়বে?
কুট্টি সম্বন্ধে আমি দীর্ঘতর আলোচনা অন্যত্র করেছি–পাঠক সেটি পড়ে দেখতে পারেন। আমার শোক-পরিতাপের অন্ত নেই যে, এ সম্প্রদায় প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে চলল। আমি জানি এদের উইট, এদের রিপোর্ট লেখাতে ও ছাপাতে সঠিক প্রকাশ করা যায় না; কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ-সম্প্রদায় সম্পূর্ণ লোপ পাওয়ার পূর্বে পুববাঙলার কোনও দরদিজন যদি এদের গল্পগুলোর একটি সগ্রহ প্রকাশ করেন, তবে তিনি উভয় বাঙলার রসিকমণ্ডলীর ধন্যবাদাহ হবেন।
***
পাঠক ভাববেন না, আমি মিষ্ট মিষ্ট গল্প বলার জন্য এ-প্রবন্ধের অবতারণা করেছি। আদপেই না। তা হলে আমি অনেক উত্তম উত্তম গল্প পেশ করতুম। এখানে গল্পের সাই ও এসোসিয়েশন অব আইডিয়াজ, কিংবা বলতে পারেন এসোসিয়েশন অব স্টরিজ বোঝাবার জন্য যেসব গল্পের প্রয়োজন আমি তারই কাঁচা-পাকা সবকিছু মিশিয়ে কয়েকটি গল্প নিবেদন করেছি মাত্র। (এবং সত্য বলতে কী, আসলে কোনও গল্পই কাঁচা কিংবা পাকা, নিরেস কিংবা সরেস নয়। মোকা-মাফিক জুৎসই করে যদি তাগ-মাফিক গল্প বলতে পারেন, তবে অত্যন্ত কাঁচা গল্পও শ্রোতমণ্ডলীর চিত্তহরণ করতে সমর্থ হবে, পক্ষান্তরে তথাকথিত শ্রেষ্ঠ গল্পও যদি হঠাৎ বেমক্কা বলে বসেন, তবে রসিকমণ্ডলী বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকাবেন।)।
গল্প বলার আর্ট, গল্প লেখার আর্টেরই মতো বিধিদত্ত প্রতিভা ও সাধনা সহযোগে শিখতে হয়। এবং দুই আর্টই ভিন্ন। অতি সামান্য, সাধারণ গল্পও পূজনীয় স্বৰ্গত ক্ষিতিমোহন অতি সুন্দর রূপ দিয়ে প্রকাশ করতে পারতেন অথচ তার লেখা রচনায় সে জিনিসের কোনও আভাসই পাবেন না; পক্ষান্তরে শ্রদ্ধেয় স্বর্গত রাজশেখরবাবু লিখে গিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ হাসির গল্প, অথচ তিনি বৈঠক-মজলিসে ছিলেন রাশভারি প্রকৃতির। গল্প বলার সময় কেউ কেউ অভিনয় যোগ করে থাকেন। সুলেখক অবধূত এ বাবদে একটি পয়লা নম্বরি ওস্তাদ। যদি কখনও তার সঙ্গে আপনার দেখা হয় তবে চন্দননগর উঁচড়ো অঞ্চলের বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক কীভাবে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন তার বর্ণনা দিতে বলবেন। কিন্তু এ প্রবন্ধের গোড়াতে যে সাবধানবাণী দিয়ে আরম্ভ করেছি, সেটি ভুলবেন না। বেমক্কা যখন-তখন অনুরোধ করেছেন, কী মরেছেন। অবধূত তেড়ে আসবে। অবধূত কেন, রসিকজন মাত্রই তেড়ে আসে। এই তো সেদিন অবধূত বলছিল, জানেন, মাস কয়েক পূর্বে ১১০ ডিগ্রির গরমে যখন ঘণ্টাতিনেক আইঢাই করার পর সবে চোখে অল্প একটু তন্দ্রা লেগে আসছে এমন সময় পাড়া সচকিত করে টেলিগ্রাম পিয়ন ঢঙের সজোরে কড়া নাড়া। দরজা খুলতে দেখি দুই অচেনা ভদ্রলোক। কড়া-রোদ্দুর, রাস্তার ধুলো-মুলোয় জড়িয়ে চেহারা পর্যন্ত ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। কী ব্যাপার? আজ্ঞে, আদালতে শুনতে পেলুম, আমাদের মোকদ্দমা উঠতে এখনও ঘণ্টা দুয়েক বাকি, তাই আপনার সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করতে এলুম। আমি অবধূতকে শুধোলুম, আপনি কী করলেন? অবধূত উদাস নয়নে ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে। আমি বেশি ঘাটালুম না। কারণ মনে পড়ে গেল, মোটামুটি ওই সময়ে চুচড়োর জোড়াঘাটের কাছে, সদর রাস্তার উপর দুটো লাশ পাওয়া যায়। খুনি ফেরার। এখনও ব্যাপারটা হিল্লে হয়নি।
ভালো করে গল্প বলতে হলে আরও মেলা জিনিস শিখতে হয় এবং সেগুলো শেখানো যায় না। আমি স্বয়ং তো আদৌ কোনও প্রকারের গল্প বলতে পারিনে। প্লট ভুলে যাই, কী দিয়ে আরম্ভ করেছিলুম কী দিয়ে শেষ করব তার খেই হারিয়ে ফেলি, গল্প আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেই খিলখিল করে হাসতে আরম্ভ করি, ঐ-যা, কী বলছিলুম প্রতি দু সেকেন্ড অন্তর অন্তর আসে, ইতোমধ্যে কেউ হাই তুললে তাকে তেড়ে যাই, শেষটায় সভাস্থ কেউ দয়াপরবশ হয়ে গল্পটা শেষ করে দেন– কারণ যে-গল্পটি আমি আরম্ভ করেছিলুম সেটি মজলিসে ইতোপূর্বে, আমারই মুখে, ভেঁড়া-ছেঁড়াভাবে অন্তত পঞ্চাশবার শুনে, জোড়া-তাড়া দিয়ে খাড়া করতে পেরেছে। তদুপরি আমার জিভে ক্রনিক বাত, আমি তোতলা এবং সামনের দু পাটিতে আটটি দাঁত নেই।