দু বছরের বাচ্চা মারা গেলে মার যে শোক হয় সে কি পঞ্চাশ বছরের ছেলে মরে যাওয়ার চেয়ে কম? আমার একটি ভাই দুই বছর বয়সে চলে যায়, কিন্তু থাক সে কথা—
***
এ-দেশে গ্রীষ্মের দিন যে কত দীর্ঘ হতে পারে সে-সম্বন্ধে আমাদের মনে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থাকলেও তার অভিজ্ঞতা না হওয়া পর্যন্ত সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা হয় না। তুলনা দিয়ে বলতে পারি, পূর্ণচন্দ্র-অমাবস্যায় কী পার্থক্য সেটা গ্রামের লোক যতখানি জানে চৌরঙ্গির লোক কি ততখানি বোঝে? আমিও এ-দেশের শহুরে; গ্রামে এসে এই প্রথম নিদাঘের দীর্ঘদিন কী সেটা প্রত্যক্ষ হৃদয়ঙ্গম হল!
সূর্য তখন অস্ত যায়নি। হঠাৎ বেখেয়ালে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি রাত আটটা। কিন্তু রাত আটটা কি ঠিক বলা হল? আটটার সময় যদি দিবালোক থাকে তবে তো সেটা এ-দেশে সকালের আটটা, দিনের আটটা? তা সে যাক। শেকসপিয়ার ঠিকই বলেছেন, নামেতে কী করে? সূর্যেরে যে নামে ডাকো আলোক বিতরে!
মধুময় সে আলো। অনেকটা আমাদের কনে দেখার আলোর মতো। কোনও কোনও গাছ, ক্ষেতে ইতোমধ্যেই পাক ধরেছে। তাদের পাতা দেখে মনে হয়, সমস্ত দিনের সোনালি রোদ খেয়ে খেয়ে সোনালি হয়ে গিয়ে এখন তারাও যেন সোনালি আলো বিকিরণ করছে। কিটস না কার যেন কবিতায় পড়েছিলুম, পাকা আঙুরগুলো সূর্যরশির স্বর্ণসুধা পান করে টইটম্বুর হয়েই যাচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে, আর তাদের মনে হচ্ছে এই নিদাঘ রৌদ্রের যেন আর অবসান নেই। আমিও এগোচ্ছি আর ভাবছি, এ-দিনের বুঝি আর শেষ নেই। এতক্ষণে বুঝতে পারলুম মারিয়ানা যখন আমাকে তাদের বাড়িতে রাতটা কাটাবার জন্য অনুরোধ করছিল তখন নানা আপত্তি দেখানো সত্ত্বেও এটা কেন বলেনি, রাতের অন্ধকারে আমি যাব কী করে? আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলেও যেমন অতিথিকে ঠেকাবার জন্য শরৎ-পূর্ণিমা-সন্ধ্যায় এ অজুহাত ভোলা চলে না, রাতের অন্ধকারে পথ দেখবেন কী করে?
গ্রামের শেষ বাড়িটার চেহারা দেখে আমার কেমন যেন মনে হল এ-বাড়িটার বর্ণনা কে যেন আমায় দিয়েছিল। হা হা, এটা আমার যাত্রারম্ভের সেই প্রথম পরিচয়ের–কী যেন নাম, হুঁ, টেরমের, হ্যাঁ, এটা সেই টেরমের, যার বউ নাকি খাণ্ডার, এটা তারই বাড়ি বটে নিশ্চয়।
সাদা রঙের বুক অবধি উঁচু ফালি ফালি কাঠের গেটের উপর দুই কনুই রেখে আবার একটি রমণী। কই, খাণ্ডারের মতো চেহারা তো ঠিক নয়। আর এই অসময়ে এখানে দাঁড়িয়েই-বা কেন? তবে কি টেরমের এখনও বাড়ি ফেরেনি?
আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলল। দেখিই না পরখ করে। সত্যি ভাণ্ডার, না, পথে যে সেই লড়াই-ফেরতা বলেছিল, একটু হিসেবি এই যা। খাণ্ডার হোক আর যাই হোক, আমাকে তো আর চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারবে না। আর খেলেও হজম করতে হবে না। এ-দেশে ভেজাল নেই। আমি নির্ভেজাল ভেজাল। ফুড-পইজনিঙে যা কাতরাতে কাতরাতে মরবে সে আর দেখতে হবে না। সখা টেরমেরও নয়া শাদি করে সুখী হবেন, কিংবা কিংবা আকছারই যা হয়, জাদু টেরটি পাবেন, পয়লা বউটি কত না লক্ষ্মী মেয়ে ছিল– খাণ্ডার তো নয়, ছিল যেন গ্রীষ্মের তৃষ্ণার কচি শসাটি। অবশ্য ইতোমধ্যে যদি আমার ভ্রাতা ইল এখানে এসে ডাক ছাড়ে, হে বাতাপে! তুমি নিষ্ক্রান্ত হও। তা হলে তো কথাই নেই, আমিও মহাভারতের ভাষাতেই বলি– খারিনীর পার্শ্বদেশ বিদীর্ণ করে সহাস্য-আস্যে নিষ্ক্রান্ত হব।
ইতোমধ্যে আমি আমার লাইন অব্ অ্যাশ অর্থাৎ বৃহ নির্মাণ করে ফেলেছি।
কাছে এসে আমার সেই ছাতা হ্যাট হাতে নিয়ে প্রায় মাটি ছুঁইয়ে, বাঁ হাত বুকের উপর রেখে, কোমরে দু ভাঁজ হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে অর্থাৎ গভীরতম বাও করে মধ্যযুগীয় কায়দায় বিশুদ্ধতম উচ্চারণে বললুম, গুন আবেন্ড, গ্লেডিগে ফ্রাউ অর্থাৎ আপনার সন্ধ্যা শুভ হোক, সম্মানিতা মহিলা।
এই সম্মানিতা মহিলা বলাটা কবে উঠে গিয়েছে ভগবান জানেন। আজ যদি আমি কলকাতায় শহরে কোনও মহিলাকে ভদ্রে বলে সম্বোধন করি, কিংবা গৃহিণীকে মুগ্ধে বলে কোনও কথা বোঝাতে যাই তা হলে যেরকম শোনাবে অনেকটা সেইরকমই শোনাল।
তার গলা থেকে কী একটা শব্দ বেরুতে না বেরুতেই আমি শুধালাম, আপনি কি দয়া করে বলতে পারেন মেলেম গ্রামটি কোথায়?
অবাক হয়ে বললে, সে তো অন্তত ছ মাইল!
আমি বললুম, তাই তো! তবে আমি নিশ্চয়ই পথ ভুল করে বসে আছি। তা সে যাকগে। আমি ম্যাপটা বের করে একটুখানি দেখে নিই। এই হাইকিঙের কর্মে আজ সকালে মাত্র হাতেখড়ি কি না।
আমি ইচ্ছে করেই বাঁচালের মতো হেসে হেসে কথাই কয়ে যেতে লাগলুম, থাকি বন্ শহরে। গরমে কলেজের ছুটিতে যে যার গেছে আপন বাড়ি। আমি কী করে যাই সেই দূর-দরাজের ইন্ডিয়ায়? এই তো ম্যাপটা পেয়েছি। ঐয টর্চটা আনিনি। বললুম তো হাতেখড়ি। তা সে—
এতক্ষণে রমণী অবাক হয়ে সেই পুরনো– এই নিয়ে চারবারের বার–ইন্ডার-ইন্ডিয়ানার গুবলেট পাকালে। সেটার আর পুনরাবৃত্তি করে কোনও লাভ নেই।
আমি বললুম, তা হলে আসি, মাদাম (যেন আমার পালাবার কতই না তাড়া)! আপনি শুধু মোটামুটি দিকটা বাতলে দিন।
কিন্তু ইতোমধ্যে দাওয়াই ধরেছে। মৃদু কণ্ঠে বললেন, চলুন। ঘরের আলোতে ম্যাপটা ভালো করে দেখে নেবেন।
আমি আমতা আমতা করে বললুম, হ্যাঁ, মাদাম, তা মাদাম, কিন্তু মাদাম—