আর যদি আমি জিতি, রেনসফর্ডের গলা থেকে শব্দগুলো যেন ধাক্কা দিয়ে দিয়ে বেরুল।
জেনারেল জারফ বললেন, তৃতীয় দিনের মধ্যরাত্রি অবধি যদি আমি আপনাকে খুঁজে না পাই তবে আমি সানন্দে আপন পরাজয় স্বীকার করে নেব। আমার নৌকা আপনাকে পার্শ্ববর্তী দেশের কোনও শহরের কাছে ছেড়ে আসবে।
জেনারেল যেন রেনসফর্ডের চিন্তা পড়ে ফেলে বললেন, ও। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। ভদ্রলোক এবং শিকারি হিসেবে আমি আপনাকে প্রত্যয় দিচ্ছি। অবশ্য আপনাকেও তার বদলে কথা দিতে হবে যে, এখানে আপনার আগমন সম্বন্ধে কিছু। বলবেন না।
রেনসফর্ড বললেন, আমি আদপেই এরকম কোনও কথা দেব না।
জেনারেল বললেন, ও? তা হলে কিন্তু এখন কেন সে আলোচনা? তিন দিন পরে দুজনাতে এক বোতল ভ্যভক্লিকো খেতে খেতে সে আলোচনা করা যাবে, অবশ্য যদি
জেনারেল মদে চুমুক দিলেন।
কারবারি লোকের ব্যস্ততা তাকে সজীব করে তুলল। রেনসফর্ডকে বললেন, ইভান। আপনাকে শিকারের কোটপাতলুন, আহারাদি ও একখানা ছোরা দেবে। আমাকে যদি অনুমতি দেন তবে বলি, আপনি নরম চামড়ার তালিওলা জুতোই পরবেন। এতে করে চলার পথে দাগ পড়ে কম। এবং পরামর্শ দিই, দ্বীপের দক্ষিণপুব কোণের বিস্তীর্ণ জলাভূমিটা মাড়াবেন না। আমরা ওটাকে মরণ-জলা নাম দিয়েছি। ওখানে চোরাবালি আছে। এক আহাম্মুক ওইদিক দিয়ে চেষ্টা দিয়েছিল। শোকের বিষয় যে, ল্যাজুরা তার পিছনে পিছনে যায়। আপনি আমার বেদনাটা কল্পনা করে নিতে পারবেন, মিস্টার রেনসফর্ড। আমি ল্যাজরাকে ভালোবাসতুম; আমার দলের ওইটেই ছিল সবচেয়ে সরেস ভালকুত্তা। তা হলে, এখন আপনার কাছে আমি ক্ষমা ভিক্ষা করছি। দুপুরে আহার করার পর আমি একটু গড়িয়ে নিই। আপনি কিন্তু নিদ্রার ফুরসত পাবেন না। নিশ্চয়ই আপনি রওনা হতে চাইবেন। গোধূলিবেলার পূর্বে আমি আপনার পেছনে বেরুব না। রাত্রিবেলার শিকারে উত্তেজনা অনেক বেশি, দিনের চেয়ে–কী বলেন? আচ্ছা তবে দেখা হবে, মিস্টার রেনসফর্ড, ও রিভোয়া।
নিচু হয়ে নম্র অভিবাদন জানিয়ে জেনারেল ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ইতান অন্য দরজা দিয়ে ঘরে এল। তার এক বগলে শিকারের খাকি পোশাক, খাবারের হ্যাঁভারস্যা, চামড়ার খাপের ভিতর লম্বা ফলাওলা শিকারের ছোরা। তার ডানহাত রক্তরঙের কোমরবন্ধের ভিতরে গোজা রিভলভারের ভোলা ঘোড়ার উপর।
দু ঘন্টা ধরে রেনসফর্ড ঝোঁপজঙ্গলের ভিতর দিয়ে যেন লড়াই করে চলেছে আর দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করেছে, আমি মাথা গরম হতে দেব না, আমার মাথা গরম হলে চলবে না।
শাটোর গেট যখন তার পিছনে কড়া করে বন্ধ হয়ে যায় তখন তার মাথা খুব পরিষ্কার ছিল না। প্রথমটায় তার সর্বপ্রচেষ্টা নিয়োজিত হয়েছিল ভার আর জেনারেল জারফের মাঝখানে যতখানি সম্ভব দূরত্ব সৃষ্টি করতে, আর ওই উদ্দেশ্য মনে রেখে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সামনের দিকে। যেন এক করাল বিভীষিকা ঘোড়সওয়ারের জুতোর কাটার মতো খোঁচা মেরে মেরে তাকে সম্মুখপানে খেদিয়ে নিয়ে চলেছিল। কিন্তু এতক্ষণে সে অনেকখানি আত্মকর্তৃত্ব ফিরে পেয়েছে; সে দাঁড়িয়ে গিয়ে তার নিজের পরিস্থিতিটা বিচার-বিবেচনা করতে লাগল।
সোজা, শুধু সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে কোনও লাভ নেই কারণ তাতে করে সে সমুদ্রের কাছে গিয়ে মুখোমুখি হবে। সে যেন চতুর্দিকে সমুদ্রের ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবির মাঝখানে; সে যা-ই করুক না কেন, এই ফ্রেমের ভিতরই তাকে সেটা করতে হবে।
রেনসফর্ড বিড়বিড় করে বলল, দেখি, আমার চলার পথ সে খুঁজে বের করতে পারে কি না। এতক্ষণ সে জঙ্গলের কাঁচা পায়ে চলার পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল, সেটা ছেড়ে এখন নামল দিকদিশেহীন ঘন জঙ্গলের ভিতর। সে অনেকগুলো জটিল ঘোর-প্যাঁচ খেয়ে তার উপর দিয়ে বার বার এলোপাতাড়ি আসা-যাওয়া করতে করতে শেয়াল-শিকারের সমস্ত কলাকৌশল, আর শেয়ালের এড়িয়ে যাবার তাবৎ ধূর্ত সধন্ধ-সুড়ুক স্মরণে আনতে লাগল। সন্ধ্যার অন্ধকার যখন নামল তখন সে গভীর জঙ্গলে ভরা একটা টিলার প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। পা দুটো শ্রমক্লান্ত, হাত আর মুখ জঙ্গলের শাখা-প্রশাখার আঁচড়ে ভর্তি। সে বেশ বুঝতে পারল, এখন তার গায়ে শক্তি থাকলেও এই অন্ধকারে দিশেহারা হয়ে চলাটা হবে বদ্ধ পাগলামি। এখন তার বিশ্রাম নেওয়ার একান্ত প্রয়োজন। মনে মনে ভাবল, এতক্ষণ আমি শেয়ালের যা করার তাই করেছি, এখন বেড়ালের খেলা খেলতে হবে। কাছেই ছিল একটা বিরাট গাছ– মোটা হুঁড়ি আর বিস্তৃত কাণ্ড নিয়ে। অতি সাবধানে সামান্যতম চিহ্ন না রেখে সে গাছ বেয়ে উঠে যেখানে একটা মোটা শাখা গুঁড়ি থেকে বেরিয়েছে সেখানে চওড়া শাখাটার উপর গা এলিয়ে দিয়ে যতখানি পারা যায় বিশ্রামের ব্যবস্থা করল। এই বিশ্রান্তি তার বুকে যেন এক নতুন আত্মবিশ্বাস এনে দিল; এমনকি সে অনেকখানি নিরাপত্তাও অনুভব করতে লাগল। মনে মনে নিজেকে বলল, জেনারেল জারফ যত বড় উৎসাহী শিকারিই হোন না কেন, এখানে তিনি তাকে খুঁজে পাবেন না। সে যে গোলকধাঁধার প্যাঁচ পিছনে রেখে এসেছে তার জট ছাড়িয়ে অন্ধকারে এই জঙ্গলের ভিতর একমাত্র শয়তানই এগুতে পারবে। কিন্তু হয়তো জেনারেল একটা শয়তানই–
আহত সর্প যেরকম ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে এগোয়, এই উদ্বেগময়ী রজনীও সেইরকম কাটতে লাগল, এবং জঙ্গলে মৃতা ধরণীর নৈস্তব্ধ্য বিরাজ করা সত্ত্বেও রেন্সফর্ডের চোখের পাতায় ঘুম নামল না। ভোরের দিকে যখন আকাশ ঘোলাটে পাঁশুটে রঙ মাখছিল তখন চমকে ওঠা একটা পাখির চিৎকার রেনসফর্ডের দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট করল। কী যেন একটা আসছে ঝাড়ঝোঁপের ভিতর দিয়ে ধীরে, সাবধানে সেই এলোপাতাড়ি গোলকধাঁধা বেয়ে, ঠিক যেভাবে রেনসফর্ড এসেছিল। ডালের উপর চ্যাপ্টা হয়ে শুয়ে পড়ে সে পাতায় বোনা প্রায় কার্পেটের মতো পুরু আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যে বস্তু আসছিল সে মানুষ।