রেনসফর্ড গরম হয়ে বলল, কিন্তু তারা মানুষ।
জেনারেল বললেন, হুবহু খাঁটি কথা। সেই কারণেই আমি ওদের ব্যবহার করি। আমি তাতে আনন্দ পাই। তারা বিচারশক্তি প্রয়োগ করতে পারে, অবশ্য যার ঘটে যেমন বুদ্ধি সেইটুকু দিয়ে। তাই তারা বিপজ্জনক।
কিন্তু শিকারের জন্য মানুষ জোগাড় করেন কী প্রকারে? রেনসফর্ড শুধাল।
ক্ষণতরে জেনারেলের বাঁ-চোখের পাতাটি নড়ে গিয়ে যেন কটাক্ষ মারল। উত্তর দিলেন, এ দ্বীপের নাম জাহাজ-ফদ দ্বীপ। কখনও কখনও ঝঞ্ঝামথিত ক্রুদ্ধ সমুদ্রদেব আমার কাছে এদের পাঠিয়ে দেন। যখন ভাগ্যদেবী অপ্রসন্না, তখন আমি তাকে কিঞ্চিৎ সাহায্য করি। আমার সঙ্গে জানালার কাছে আসুন।
রেনসফর্ড জানালার কাছে এসে বাইরের সমুদ্রের দিকে তাকাল।
জেনারেল বলে উঠলেন, লক্ষ করুন! ওই ওখানে বাইরে! রেনসফর্ড শুধু নিশির অন্ধকার দেখতে পেল। তার পর যেই জেনারেল একটি বোতাম টিপলেন অমনি দূর সমুদ্রে একাধিক আলোর ছটা দেখতে পেল।
জেনারেল পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, ওই আলোকগুলোর অর্থ, ওখানে চ্যানেল পথ আছে যেখানে সে জাতীয় কিছুই নেই। বিরাট বিরাট পাথর তাদের ক্ষুরের মতো ধারালো পাশ নিয়ে হাঁ করে ঘাপটি মেরে বসেছে সমুদ্রদৈত্যের মতো। তারা অতি অক্লেশে একখানা জাহাজ গুঁড়িয়ে চুরমার করে দিতে পারে এই যেরকম আমি অক্লেশে এই বাদামটা খুঁড়িয়ে দিচ্ছি। তিনি শক্ত কাঠের মেঝের উপর একটি বাদাম ফেলে দিয়ে জুতোর হিল দিয়ে খুঁড়িয়ে চুরমার করে দিলেন। যেন কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নিতান্ত কথায় কথায় বললেন, আমার ইলেকট্রিকের ব্যবস্থা আছে। আমরা এখানে সভ্য থাকবার চেষ্টা করি।
সত্য? আর আপনি গুলি করে মানুষ খুন করেন?
জেনারেলের কালো চোখে ক্রোধের সামান্য রেশ দেখা দিল। কিন্তু সেটা এক সেকেন্ডের তরে। অতি অমায়িক কণ্ঠে বললেন, হায় কপাল! কী অদ্ভুত নীতিবাগীশ তরুণই-না আপনি! আমি আপনাকে প্রত্যয় দিচ্ছি, আপনি যা বলতে চাইছেন আমি সেরকম কিছুই করি না। সেটা হবে বর্বরতা। আমি আমার অতিথিদের চরম খাতিরযত্ন করে থাকি। তারা প্রচুর খাদ্য পায়, প্রয়োজনীয় কায়িক পরিশ্রম করে শরীর সুস্থ-সবল রাখতে পায়। তাদের স্বাস্থ্য চমৎকার হয়ে ওঠে। কাল আপনি নিজেই দেখতে পাবেন।
মানে?
মুচকি হেসে জেনারেল বললেন, কাল আমরা আমার ট্রেনিং স্কুল দেখতে যাব। স্কুলটা মাটির নিচের সেলারে। উপস্থিত সেখানে আমার প্রায় ডজন খানেক ছাত্র আছে। তারা এসেছে হিসপানি বোট সানলুকার থেকে জাহাজখানার দুর্ভাগ্যবশত সেটা ওই হোথায় পাথরগুলোর সঙ্গে ধাক্কা খায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সবকটাই অতিশয় নিরেস, বাজে-মার্কা ডেকের উপর চলা-ফেরাতে যতখানি অভ্যস্ত, জঙ্গলে ততখানি নয়।
তিনি হাত তুলতেই ইভান- সে-ই ওয়েটারের কাজ করছিল– গাঢ় টার্কিশ কফি নিয়ে এল। রেনসফর্ড অতিকষ্টে নিজেকে কথা বলা থেকে ঠেকিয়ে রাখছিল।
ঢাকঢাক গুড়গুড় না করে খোলাখুলিভাবে জেনারেল বলে যেতে লাগলেন, বুঝতে পারছেন তো এটা হচ্ছে শিকারের ব্যাপার। আমি এদের একজনকে আমার সঙ্গে শিকারে যেতে প্রস্তাব করি। আমি তাকে যথেষ্ট খাদ্য আর উৎকৃষ্ট একখানা শিকারের ছোরা দিয়ে আমার তিন ঘন্টা আগে বেরুতে দিই। পরে বেরুই আমি, সবচেয়ে ছোট ক্যালিবারের আর সবচেয়ে কম পাল্লার মাত্র একটি পিস্তল নিয়ে। পুরো তিন দিন যদি সে আমাকে এড়িয়ে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে তবে সে জিতল। আর আমি যদি তাকে খুঁজে পাই জেনারেল মুচকি হেসে বললেন, তবে সে হারল।
সে যদি শিকার হতে রাজি না হয়?
ও! সেটা বাছাই করা নিশ্চয়ই আমি তার হাতে ছেড়ে দিই। সে যদি না খেলতে চায় তবে খেলবে না। সে যদি শিকারে যেতে রাজি না হয় তবে আমি তাকে ইভানের হাতে সমৰ্পণ করি। ইভান একদা মহামান্য তে জারের সরকারি চাবুকদারের সম্মানিত চাকরি করেছে। এবং খেলাধুলা, শিকার বাবদে সে আপন নিজব ধারণা পোষণ করে। কোনও ব্যত্যয় হয় না, মিস্টার রেনসফর্ড, কোনও ব্যত্যয় হয় না। তারা সব্বাই আমার সঙ্গে শিকার করাটাই পছন্দ করে নেয়।
আর যদি তারা জিতে যায়?
জেনারেলের মৃদু হাস্য আরও বিস্তৃত হল। বললেন, আজ পর্যন্ত আমি হারিনি।
সঙ্গে সঙ্গে তাড়াতাড়ি যোগ করলেন, আপনি ভাববেন না, মিস্টার রেনসফর্ড, আমি দেমাক করছি। বস্তুত ওদের বেশিরভাগই অতিশয় সরল সমস্যা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। মাঝে মাঝে দু-একটা দুদে দেখা দেয় বটে। একজন প্রায় জিতে গিয়েছিল। শেষটায় কুকুরগুলোকে ব্যবহার করতে হয়েছিল আমাকে।
কুকুর?
এদিকে আসুন; আপনাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।
জেনারেল রেনসফর্ডকে একটা জানালার কাছে নিয়ে গেলেন। জানালার আলোগুলো নিচের আঙিনায় আলো-ছায়ার হিজিবিজি প্যাটার্ন তৈরি করছিল। রেনসফর্ড সেখানে ডজনখানেক বিরাট আকারের কালো প্রাণীকে নড়াচড়া করতে দেখল। তারা তার দিকে মুখ তুলতেই তাদের চোখে সবুজ রঙের ঝিলিমিলি খেলে গেল।
জেনারেল মন্তব্য করলেন, আমার মতে উত্তম শ্রেণির। প্রতিরাত্রে সাতটার সময় এদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কেউ যদি আমার বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করে কিংবা বেরিয়ে যাবার তবে তার পক্ষে সেটা শোচনীয় হতে পারে। জেনারেল গুন গুন করে ফলি বেজেঁরের একটি গানের কলি ধরলেন।