তবু তাকে আমি উরাতুম। কিন্তু যেদিন শুনলুম, সুরেশচন্দ্র অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন সরলাবালাকে এবং তিনি আমার রচনার ওপর আশীর্বাদ রেখেছেন, সেদিন আমার মনে এক অদ্ভুত সাহস সঞ্চার হল। আমার মনে হল, পত্রিকা জগতের সুপ্রিমকোর্টের (তখন বোধহয় প্রিতি কৌন্সিল ছিল) চিফ জসটিসের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে গেল, সে জগতে যদি আমার মনোবেদনার কারণ ঘটে, তবে আপিল করব খুদ সুপ্রিমকোর্টে! অবশ্য আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমাকে কখনও স্মল-কজ কোর্টে যেতে হয়নি। হবে না, সে বিশ্বাসও ধরি।
এটা আমার ব্যক্তিগত কথা নয়। বহু কর্মী, প্রচুর সাহিত্যিক আমার কথায় সায় দেবেন।
সরলাবালা ফ্যাঁ দ্য সিয়েক্লের (এন্ড অব দি সেরির) লোক। গত শতাব্দীর শেষ এবং এ শতাব্দীর অর্ধাধিক তিনি দেখেছেন। ফরাসিতে যেমন এঁদের ফ্যাঁ দ্য সিয়েক্লের প্রতিভূ বলে, আরবিতে ঠিক তেমনি বলে জু অল-করনেন দুই শতাব্দীর মালিক। এদের সম্বন্ধে লেখা কঠিন। বঙ্কিম-রমেশের মধ্যাহ্ন গগন, রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের উদয় সরলাবালা চোখের সামনে দেখেছেন–এবং আর পাঁচজনের তুলনায় অনেক বেশি ভালো করে দেখেছেন, কারণ সাহিত্যে তাঁর রসবোধ ছিল তো বটেই, তদুপরি তার আসন ছিল ঘোষ-সরকার উভয় পরিবারের পত্রিকা-জগতের মাঝখানে। এদিকে বৈষ্ণবধর্মের রসকুণ্ডে তিনি আবাল্য নিমজ্জিতা, অন্যদিকে শ্রীরামকৃষ্ণের আন্দোলন, বিবেকানন্দের সকর্মযোগ এবং সর্বশেষ শ্রীঅরবিন্দের সাধনায় তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী। অত্যন্ত উদারচিত্ত না হলে মানুষ এ তিনটেকে একসঙ্গে গ্রহণ করতে পারে না। আমার কাছে আরও আশ্চর্য বোধ হয়, যে রমণী কোনও বিদ্যালয়েও কখনও যাননি, চিরকাল অন্তঃপুরের অন্তরালেই রইলেন, তাঁর পক্ষে এতখানি উদার, এতখানি ক্যাথলিক হওয়া সম্ভব হল কী প্রকারে।
ফ্যাঁ দ্য সিয়েক্ল সম্বন্ধে আমরা অনেক কিছু পড়েছি, কিন্তু তার অধিকাংশ অধিকাংশ কেন, প্রায় সমস্তটাই পুরুষের লেখা। তার মাঝখানে সরলাবালার কোমল নারীহৃদয় সবকিছু অনুভব করেছে হৃদয় দিয়ে, মাতুরসে সিক্ত করে। ইংরেজিতে বলতে গেলে বলব, তার বর্ণনা রিছ উইদ নলেজ না হতে পারে সর্বক্ষেত্রে, কিন্তু নিশ্চয় নিশ্চয় অতিনিশ্চয় রেডিয়েন্ট উইদ লা।
অথচ তার লেখাতে ভাবালুতা উসপ্রবণতা নেই। অত্যন্ত মধুর, আন্তরিক লেখার মধ্যেও সর্বক্ষণ পাই, কেমন যেন একটা বৈরাগ্যের ডিটাচমেন্টের ভাব। আমার মনে হয়, তিনি বাল্যকাল থেকে অনেক শোক পেয়েছিলেন বলেই বৈরাগ্যযোগে আপন চেষ্টায় সেসব শোক সংহরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর রচনাতে পদে পদে তারই পরিচয় পাই।
ছেলের হৃদয়ের আঁকুবাঁকু মা কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারেন, এবং তিনি যখন সেটা সরল ভাষায় প্রকাশ করেন, তখন ছেলে বিস্ময় মানে, যে জিনিস সেই ভালো করে বুঝতে পারেনি, মা বুঝল কী করে এবং এত সরল ভাষায় প্রকাশ করল কী করে?
বাঙলার চিন্ময় জগতে সরলা ছিলেন মাতৃরূপা। অতি অল্প বয়সেই তিনি মাতৃক্রোড় পেতে দিয়েছিলেন বাঙলার তরুণকে। তাই শুনতে পাই, বাঙালির ওপর যখনই অত্যাচার এসেছে, তিনি ক্ষুব্ধ মাতার মতো অনশন করেছেন। এবং তাই তিনি শেষ দিন পর্যন্ত বাঙালির মনোবেদনা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে অতি মহৎ ভাষায় সেটি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন।
সে ভাষায় আছে দার্ঢ্য অথচ মাধুর্য।
এবং সর্বোপরি সে ভাষা অতিশয় সরলা।
সার্থক নাম সরলাবালা ॥
সর্বাপেক্ষা সঙ্কটময় শিকার
উইটনি বলল, ডান দিকে ঠিক কোথায় জানিনে বেশ বড় একটা দ্বীপ রয়েছে। সে একটা রহস্য
রেনসফর্ড শুধাল, নাম কী দ্বীপটার?
পুরনো দিনের ম্যাপে নাম রয়েছে জাহাজ-ফাঁদ দ্বীপ। নামটার থেকেই অর্থ কিছুটা আমেজ করা যায়, নয় কি? মাঝি-মাল্লাদের ভিতর দ্বীপটার প্রতি কেমন যেন একটা অদ্ভুত ভয়। কী জানি কেন। কিছু একটা কুসংস্কার বোধহয়
ইয়ট জাতের ছোট্ট জাহাজধানির চতুর্দিকে গরম দেশের গাঢ়, ভেজা ভেজা অন্ধকার যেন চেপে ধরেছে। তারই ভিতর দিয়ে দৃষ্টি চালাবার নিষ্ফল চেষ্টা করে রেসফ বলল, ওটাকে দেখতে পাচ্ছিনে তো।
উইটনি হেসে বলল, তোমার দৃষ্টিশক্তি খুবই প্রখর সে আমি জানি। চারশো গজ দূর থেকে মূস-মোষের মতো শিকারকে ঝোঁপের ভিতর দেখে ফেলতে আমি তোমাকে দেখেছি কিন্তু ক্যারেবিয়ান সমুদ্রের অন্ধকার রাত্রে চার-পাঁচ মাইল দূর পর্যন্ত দেখা তোমারও কর্ম নয়।
রেনসফর্ড সম্মতি জানিয়ে বললে, চার গজও না। আখ–অন্ধকারটা যেন কালো মখমল।
উইটনি যেন আশ্বাস দিয়ে বলল, রিয়ো পৌঁছলে বিস্তর আলোর মেলা পাবে, ভয় কী! কয়েকদিনের ভিতরেই সেখানে পৌঁছে যাচ্ছি। জাগুয়ার শিকারের বন্দুকগুলো পর্দোর কাছ থেকে পৌঁছে গেলেই হয়। আমাজন অঞ্চলে উত্তম শিকার পাব বলে আশা করছি। শিকারের মতো আর কোনও খেলই হয় না।
পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা খেল। সম্মতি জানালে রেনসফর্ড।
কিঞ্চিৎ সংশোধন করে উইটনি বলল, শিকারির পক্ষে জাগুয়ারের পক্ষে নয়।
আবোল-তাবোল বকো না, উইটনি। তুমি বড় বড় জানোয়ারের শিকারি–তুমি দার্শনিক নও। জাগুয়ার কী অনুভব করে, না করে তাতে কার কী যায়-আসে?
হয়তো জাওয়ারের যায়-আসে।
ছেঃ! তারা আবার ভাবতে পারে নাকি?
তা সে যাই হোক, আমার কিন্তু মনে হয়, তারা অন্তত একটা জিনিস বোঝে–ভয়। যন্ত্রণার ভয় আর মৃত্যুভয়।