যারা হিন্দি জানেন তারা হিন্দির বিরুদ্ধে আর একটি আপত্তি উত্থাপন করেছেন। হিন্দিতে বলি, মৈ রোটি খাতা- আমি রুটি খাই, কিন্তু অতীতকাল নিলে বলতে হয় মৈ নে রোটি খাই- আমি রুটি খেয়েছি। অর্থাৎ অতীতকালে আমি আর কর্তা থাকলুম না, কর্তা হয়ে গেলেন রুটি এবং সেই অনুযায়ী ক্রিয়াপদ স্ত্রীলিঙ্গ হয়ে গেল, কারণ রোটি হিন্দিতে স্ত্রীলিঙ্গ (পানি, ঘি, দহি, মোতির মতো মাত্র কয়েকটি ই-কারান্ত শব্দ স্ত্রীলিঙ্গ; তাই পুংভূষণ দাড়ি বেচারি স্ত্রীলিঙ্গ হয়ে গিয়েছে। তার মানে আমা-দ্বারা রুটি খাওয়া হল বললে অনেকটা হিন্দির ওজনে বলা হল। কিংবা পাগলে কি না বলে! সংস্কৃতে এরকম জিনিস আছে একথা সকলেই জানেন।
কিন্তু এসব সমস্যা অপেক্ষাকৃত সরল। একবার কোন শব্দ কোন লিঙ্গ জানা হয়ে গেলে বাদবাকি জট তিন লহমায় ছাড়িয়ে নেওয়া যায়।
লিঙ্গ নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করে কোনও লাভ নেই। আমরা যদি হিন্দিভাষীকে বলি লিঙ্গ তুলে লড়কা জাতা, লড়কি জাতা বলা আরম্ভ করে দাও, তবে ইংরেজ বাঙালিকে বলবে, আমি গেলুম, তুমি গেলুম, সে গেলুম, বলতে আরম্ভ কর। তাই ইংরেজ ফরাসি লেখার সময় ফরাসির লিঙ্গবিচার নিয়ে আপত্তি তোলে না। চাঁদপানা মুখ করে, মুখস্থ করে শব্দের অন্তে বি, সি, ডি, জি, এল, পি, কিউ, জেড থাকলে শব্দ পুংলিঙ্গ হয় অবশ্য বিস্তর ব্যত্যয় আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফরাসিতে হিন্দির মতো মাত্র দুটি লিঙ্গ কিন্তু আমার মনে হয়, ফরাসিতে লিঙ্গবিচার হিন্দির চেয়ে শক্ত।
এটা অবশ্য অসম্ভব নয় যে, হিন্দি বহু বহু প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর প্রাদেশিক অজ্ঞতাবশত লিঙ্গে ভুল হতে আরম্ভ হবে এবং তারই ফলে হয়তো একদিন হিন্দি থেকে লিঙ্গ লোপ পেয়ে যাবে। তবে তার ফললাভ আমরা করতে পারব না সেকথা সুনিশ্চিত।
.
০৬.
হিন্দি-বিরোধী সম্প্রদায় বলেন, হিন্দিতে এমন কী সাহিত্য আছে, বাপু, যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হিন্দি শিখতে যাব? উত্তরে হিন্দির দল বলেন, তাবৎ ভারত যদি হিন্দি গ্রহণ করে সে ভাষাতে সাহিত্যসৃষ্টি আরম্ভ করে তবে দেখতে না দেখতেই হিন্দি ইংরেজি-ফরাসির সঙ্গে পাল্লা দিতে আরম্ভ করবে।
এ উত্তরটা ইতিহাসের ধোপে টেকে না। সকলেই জানেন, এককালে লাতিন সর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রভাষা ছিল কিন্তু তৎসত্ত্বেও লাতিন ভাষা গ্রিক কিংবা সংস্কৃতের মতো উচ্চাঙ্গ সাহিত্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। তার পর ফরাসি ভাষা লাতিনের আসনটি কেড়ে নিল। কিন্তু ফরাসি সাহিত্য যে বিত্তবান হল সেটা ইংরেজ, জর্মন, ইতালীয়দের ফরাসি সাহিত্য-চর্চা করার ফলে নয়– ফরাসির ব্যাপক সাহিত্য গড়ে উঠেছে ফরাসি যাদের মাতৃভাষা একমাত্র তাদেরই প্রচেষ্টার ফলে। ঠিক সেই কারণেই প্রশ্ন, কটা বিদেশি ইংরেজিতে লিখে নাম করতে পেরেছে কিংবা কজন ইংরেজ ফরাসি-জনে লিখে সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করতে পেরেছে ইংরেজিতে ফিরে যাই; ফরাসির পর এই যে ইংরেজি বনজুড়ে রাজত্ব করল সে ভাষাতেই-বা কটি বিদেশি নাম করতে পেরেছেন? এমনকি, কজন অস্ট্রেলিয়া কিংবা কানাডাবাসী ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চাঙ্গের রচনা লিখতে সক্ষম হয়েছে? এ জিনিসটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তবে কি ভাষাকে টবে পুঁতে বিদেশে পাঠালে সেখানে সে বেঁচে থাকতে সক্ষম হলেও ফল দিতে পারে না? আমেরিকার মতো বিরাট দেশে তো আরও বেশি লেখকের জন্ম নেবার কথা ছিল– একদম পয়লা নম্বরের লেখক সে মহাদেশে জন্মেছেন কজন? অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকাবাসীর মাতৃভাষা ইংরেজি– তারাই যদি এ বাবদে কাহিল তবে যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয় তারাই-বা কোন গন্ধমাদন উত্তোলন করতে পারবেন?
অথচ দেখুন, লাতিন-ফরাসির একচ্ছত্রাধিপত্য যেমন যেমন লোপ পেল সঙ্গে সঙ্গে জর্মন, ইংরেজি, ইতালি, রুশ, সুইডিশ, ওলন্দাজ সাহিত্য কী অল্প সময়ে কত না কত অদ্ভুত উন্নতি সাধন করতে পেরেছে। তাই আজ আধমরা লাতিনের জায়গায় জেগে উঠেছে বহুতর ভাষা গরুড়ের ক্ষুধা নিয়ে। তাই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি বহু ভাষার শিখতোরণ, মিনার-গম্বুজ দিয়ে গড়া ইউরোপীয় সাহিত্য নামক এক গগনচুম্বী তাজমহল।
ইংরেজ ফরাসি ভাষায় লেখে না, ফরাসি জর্মনে লেখে না, রুশ দিনেমার ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করতে যায় না, তথাপি এদের ভিতর আন্তরিক সহযোগিতার অন্ত নেই। আজ ফরাসি দেশে যে গকুর পুরস্কার পায় কালই তার বই ইংরেজিতে তর্জমা হয়ে যায় অধিকাংশ স্থলে প্রাইজ পাওয়ার বহু পূর্বেই তর্জমা হয়ে গিয়েছে। আর নোবল পেলে তো কথাই নেই– হুস হুস করে ডজনখানেক ভাষায় খান বিয়াল্লিশ তর্জমা বাজার গরম করে তোলে।
ইংরেজ গেছে, আপদ গেছে। এখন আমি স্বপ্ন দেখি–সুশীল পাঠক তুমিও যোগ দাও– ভারতবর্ষের নানা ভাষায় যেন উত্তম উত্তম সাহিত্য সৃষ্টি হয় এবং এক সাহিত্যের ভালো লেখা যেন অন্য সব সাহিত্যে অনুবাদ করা হয়। ইংরেজের মতলব ছিল প্রদেশে প্রদেশে যেন ভাবের আদান-প্রদান না হয়। তৎসত্ত্বেও আমরা ইংরেজির মাধ্যমে একে অন্যকে কিছুটা চিনতে পেরেছি কিন্তু বহুস্থানেই অনেকখানি ভুল চেনাশোনা হয়েছে। এবার সৎসাহিত্যের ভিতর দিয়ে আসল সদালাপ আরম্ভ হবে– আমরা এই স্বপ্ন দেখি।
বাঙলা বই হিন্দিতে অনুবাদ হবে, তার পর হিন্দি থেকে তামিলে– এ ব্যবস্থা আমার মনঃপূত হয় না। জ্যামিতি নাকি সপ্রমাণ করতে পারে, ত্রিভুজের যে কোনও এক বাহু যে কোনও দুই বাহুর চেয়ে হতর।