আমি চুপ করে বারান্দায় ভাবতে বসতুম– নাহ, এ কবরেজটা কোনও কর্মের নয়। কিন্তু শহরের এই তো নামকরা শেষ কবরেজ। তবে দেখি হেকিম সায়েবকে দিয়ে কিছু হয় কি না—
আপনারা হয়তো ভাবছেন, চৌদ্দ বছরের ছেলে করবে এসব ডিসিশন! বাড়ির কর্তারা করছিলেন কী?
আসলে আমি বুঝতে পারতুম না, কর্তারা, দাদারা এমনকি মা পর্যন্ত অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলেন, আমার ভাইটি বাঁচবে না। তারা আমাকে সে খবরটি দিতে চাননি। আমার জনের পূর্বে আমার এক দাদা আর দিদিও ওই ব্যামোতে যায়।
ডাক্তার-কবরেজরাও আমার দিকে এমনভাবে তাকাতেন যে, তার অর্থটা আজ আমার কাছে পরিষ্কার– তখন বুঝতে পারিনি। তবু তাদের এই চৌদ্দ বছরের ছেলেটির প্রতি দরদ ছিল বলে আসতেন, নাড়ি টিপতেন, ওষুধ দিতেন।
ওই দুই বছরের ভাইটি কিন্তু আমাকে চিনত সবচেয়ে বেশি–কী করে বলতে পারব না। আমাকে দেখামাত্রই তার রোগজীর্ণ শুকনো মুখে ফুটে উঠত ম্লান হাসি।
সে হাসি একদিন আর রইল না। আমাকে সে ডরাতে আরম্ভ করল। আমাকে দেখলেই মাকে সে আঁকড়ে ধরে রইত। আমার কোলে আসতে চাইত না। আমার দোষ, আমি কবরেজের আদেশমতো তার নাক টিপে, তাকে জোর করে তেতো ওষুধ খাইয়েছিলুম।
ওই ভয় নিয়েই সে ওপারে চলে যায়।
তার সেই ভীত মুখের ছবি আমি বয়ে বেড়াচ্ছি, বাকি জীবন ধরে।
***
ঠিক এক বছর পূর্বে আমার এক প্রিয়-বিয়োগ হয়। এবারেরটা নিদারুণতর। কিন্তু ওই যে বললুম, এটা আর বেশিদিন ধরে বয়ে বেড়াতে হবে না।
কিন্তু প্রশ্ন, আমি এসব করুণ কথা পাড়ছি কেন? বিশ্বসংসার না জানুক, আমার যে কটি পাঠক-পাঠিকা আছেন তারা জানেন আমি হাসাতে ভালোবাসি। কিন্তু উল্টোরথের পাঠক-পাঠিকারা নিত্য নিত্যি সিনেমা দেখতে যান সেখানে করুণ দৃশ্যের পর করুণ দৃশ্য দেখে ঘটি ঘটি চোখের জল ফেলেন। ভগ্নহৃদয় নায়ক কীরকম খোঁড়াতে খোঁড়াতে দূর দিগন্তে বিলীন হয়ে যান, আর সুস্থহৃদয় নায়িকা কীরকম ড্যাং ড্যাং করে বিজয়ী সপত্বের সঙ্গে ক্যাডিলাক গাড়ি চড়ে হানিমুন করতে মন্টিকালো পানে রওনা হন। আমার করুণ-কাহিনী তো তাদের কাছে ডাল-ভাত।
তবু আমি ব্যক্তিগত জীবন দিয়ে এ রচনা আরম্ভ করেছি মহত্তর আদর্শ নিয়ে।
আমাদের সবচেয়ে বড় কবি রবীন্দ্রনাথ। তিনি আর পাঁচটা রসের সঙ্গে হাস্যরসও আমাদের সামনে পরিবেশন করেছেন, অথচ কেউ কি কখনও চিন্তা করে, তার জীবনটা কীরকম বিষাদবহুল ঘটনায় পরিপূর্ণ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস অন্য যে কোনও সাধারণজন এরকম আঘাতের পর আঘাত পেলে কিছুতেই আর সুস্থ জীবনযাপন করতে পারত না। অথচ রবীন্দ্রনাথকে দেখলে বোঝা যেত না, কতখানি শোক তিনি বুকের ভিতর বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি ভেঙে তো পড়েনইনি, এমনকি তীব্র শোকাবেগে কখনও কোনও অধর্মাচরণও করেননি– অর্থাৎ কাব্য সাহিত্য সৃষ্টি, যা তার ধর্ম সেটি থেকে বিচ্যুত হননি। তার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তার ঋষিতুল্য সর্বজ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলেন, আমাদের সকলেরই পা পিছলিয়েছে– রবির কিন্তু কখনও পা পিছলোয়নি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর মায়ের আদর পাননি। কিন্তু তার বয়স যখন ৭৮ তখন তার দাদা বিয়ে করে আনলেন কাদম্বরী দেবীকে। বয়সে দুজনাই প্রায় সমান। কিন্তু মেয়েদের মাতলু-বোধটি অল্প বয়সেই হয়ে যায় বলে তিনি তাঁর মায়ের অভাব পূর্ণ করে দেন। এই সমবয়সী দেবরটিকে তিনি দিয়েছিলেন সর্বপ্রকারের স্নেহ ভালোবাসা। প্রভাত মুখো-র রবীন্দ্রজীবনীতে তার সবিস্তার পরিচয় পাঠক পাবেন।
এই প্রাণাধিকা বউদিটি আত্মহত্যা করেন রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন বাইশ। কী গভীর শোক তিনি পেয়েছিলেন তা তাঁর কাব্যে বার বার প্রকাশ পেয়েছে। অধ্যাপক অমিয় চক্রবর্তীর ভ্রাতা আত্মহত্যা করলে পর বৃদ্ধ কবি তাকে তখন সান্ত্বনা দিয়ে একখানি চিঠি লেখেন। সেটিও রবী-জীবনীতে উদ্ধৃত হয়েছে। পাঠক পড়ে দেখবেন। কী আশ্চর্য চরিত্রবল থাকলে মানুষ এমনতরো গভীর শোককে আপন ধ্যানলোকে শান্ত সমাহিত করে পরে রসরূপে, কাব্যরূপে নানা ছন্দে নানা গানে প্রকাশ করতে পারে, পাঠক, শ্রোতার হৃদয় অনির্বচনীয় দুঃখে-সুখে মেশানো মাধুর্যে ভরে দিতে পারে। কবির ক্ষয়ক্ষতি বাংলা কাব্যের অজরামর সম্পদে পরিবর্তিত হল। এর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গত হলেন, পিতা গত হলেন- এগুলো শুধু বলার জন্যে বললুম, হিসাব নিচ্ছি না।
তার পর পুরো কুড়ি বছর কাটেনি আরম্ভ হল একটার পর একটা শোকের পালা।
প্রথমে গেলেন স্ত্রী।(১) তার বয়স তখন ত্রিশ পূর্ণ হয়নি। (বড় মেয়ে মাধুরীলতার বিয়ের কয়েক মাস পরেই।} তিন কন্যা আর দুই পুত্র রেখে। সর্বজ্যেষ্ঠর বয়স পনেরো, সর্বকনিষ্ঠের সাত। মাধুরীলতা ছাড়া আর সব কটি ছেলে-মেয়ে মানুষ করার তার রবীন্দ্রনাথের হাতে পড়ল। রবীন্দ্রনাথের শিষ্য অজিত চক্রবর্তীর (কাব্যপরিক্রমার লেখক) মাতা কৰিজায়ার মৃত্যুর কুড়ি বৎসর পর আমাকে বলেন, মৃণালিনী দেবী তার রোগশয্যায় এবং অসুস্থাবস্থায় তার স্বামীর কাছ থেকে যে সেবা পেয়েছিলেন তেমনটি কোনও রমণী কোনওকালে তার স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছে বলে তিনি জানেন না। তিনি বলেন, স্ত্রীর মানা অনুরোধ না শুনে তিনি নাকি রাত্রির পর রাত্রি তাকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করেছেন।
রবীন্দ্রকাব্যের সঙ্গে যারা পরিচিত তারাই জানেন, স্পর্শকাতর কবিকে এই মৃত্যু কী নিদারুণ অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে তাকে জীবনের রহস্য শেখায়। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৪০/৪১- দেখাত ৩০/৩১। অটুট স্বাস্থ্য। কিন্তু তিনি পুনরায় দারুগ্রহণ করেননি।