কিন্তু ১৯১৩ থেকে ১৯৬৫– এই দীর্ঘ বাহান্ন বৎসরের একনিষ্ঠ সাধনা তো ক্ষুদ্র একটি প্রবন্ধে শেষ করা যায় না। যদি কখনও সে সাধনার সিকি পরিমাণ খবরাখবর সংগ্রহ করতে পারি তবে পুনরায় চেষ্টা নেব।(২)
৯।১০।৬৫
———
১. মৃত্যু : ৪৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ কঙ্গোতে।
২. শ্বোয়াইৎসার ভারতীয় চিন্তাধারা সম্বন্ধে ১৯৩৫ সালে Dei Weltanse-hauung der indischen Denker নামক একখানা বই লেখেন। এই বই সম্বন্ধেও অনেক কিছু বলার আছে। আমি বহু বৎসর পূর্বে পড়েছি। সেখানি ফের পেলে কিছু লেখার দুরাশা আছে।
ইন্টারভ্যু
‘ইন্টারভ্যু’ নামক চরম বেইজ্জতির মস্করা যে কত নব নব রূপে প্রকাশিত হয় তার বর্ণনা আরেক দিন দেব। ‘দেশে’ এই মর্মে একাধিক চিঠি বেরিয়েছে, এবং আগে-ভাগে কাকে চাকরি দেওয়া হবে সেটা ঠিক করে নিয়ে যে চোট্টামির ইন্টারভ্যু-প্রহসন করা হয় তারও বর্ণনা এ চিঠিগুলোতে ও আমার সতীর্থের মূল প্রবন্ধে আছে। তবে এ বাবদে শেষ কথা বলেছে আমার এক তুখোড় তালেবর ভাগিনা। ডাঙর নোকরি করে, ঢাউস যা গাড়ি ব্যাঙ্ক দিয়েছে তার ভিতর। এক পক্ষে মা-সহ তার তিন মাসী, অন্য পক্ষে তার তিন মামী রীতিমতো ব্যূহ নির্মাণ করে কাশ্মির-শিয়ালকোট-কচ্ছের রনের(১) রণমোহড়া দিতে পারেন (বলা বাহুল্য মামীরাই হারেন, কারণ তাঁরা এসেছেন তিন ভিন্ন ভিন্ন পরিবার থেকে)। ভাগিনাটিকে প্রায়ই ইন্টারভ্যু নিতে হয়– অর্থাৎ সিটস অন দি রাইট সাইড অব দি টেবল। একদিন বেজায় উত্তেজিত হয়ে সে আমাকে একটি কর্ম-খালির বিজ্ঞাপন পড়ে শোনালে। তাতে ওমেদারের বয়স কত হবে, কী কী পাস থাকা চাই, এপেনডিকসের দৈর্ঘ্য তার কতখানি হবে, তার পরিবারে নিদেন কটা খুন হয়ে থাকা চাই ইত্যাদি বেবাক বাৎ ছিল। ভাগিনা তার পর ভ্রুকুঞ্চিত করে খানিকক্ষণ খুঁত খুঁত করে বললে, ‘খাইছে! ফোডোগেরাপ দ্যাওনের বাৎ বেবাক ভুল্যা গ্যাছে। হুইডার তলায় লেখা থাগব, “None need apply whose appearance does not resemble the above photograph.” কী কন, মামু?’ আমি আর কী বলব? এটা করলে তো অত্যন্ত সাধু জনোচিত আচরণ হত। এর চেয়ে ঢের নাস্টি (ইচ্ছে করে ন্যাষ্টি উচ্চারণ করতে, সে উচ্চারণে ঘেন্নাটার খোলতাই হয় বেশি যেমন ‘পিশাচ’ বা ‘পিচাশ’ না বলে সর্বোৎকৃষ্ট হয় ‘পিচেশ’ বললে!) উদাহরণ আমি এটা জানি।
ফার্সির লেকচারার নেওয়া হবে। আমাকে স্পেশালিস্ট হয়ে যেতে হবে। আমি বেকসুর না-মঞ্জর করে দিলুম। যদিও চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে মনে হল না, এর ভেতরে কোনও নষ্টামি আছে। তবু, আমি এই ‘জামাই ঠকানো’র– সুনন্দের ভাষায়– ফিকিরি-মস্করার হিস্যেদার হতে চাইনে। দু দিন পর মৌলানা আজাদ ফোন করে জানতে চাইলেন, আমি যেতে আপত্তি করছি কেন? তখন বুঝলুম, উনিই আমার নাম স্পেশালিস্ট রূপে প্রস্তাব করেছিলেন এবং এখন আমি সেটি গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হচ্ছি বলে কর্তৃপক্ষ তাঁকে সেটা জানিয়ে ফরিয়াদ করেছেন–। মৌলানার পাণ্ডিত্যের প্রতি আমার অসাধারণ শ্রদ্ধা ছিল। তাই কাঁচুমাচু হয়ে এই ইন্টারভ্যু বাবদে পরীক্ষক হিসেবেই, আমার পূর্ব পূর্ব নোংরা (ন্যাষ্টি!) তজরুবা-অভিজ্ঞতা জানালুম। দেখি, মৌলানা সমুচাহ্ ওয়াকিফ-হাল! কোনও প্রকারের তর্কাতর্কি না করে বললেন, আপনি গেলে ওরা সোজা পথে চলবে। যদি অন্যায় আচরণ দেখেন, আমাকে জানাবেন। ইন্টারভ্যুতে যেসব অনাচার হয় তার কোনও বিচার নেই বলে, আমি টেবিলের কি এদিকে কি ওদিকে কোনও দিকে বসতে চাইনে (পেত্যয় না। পেলে শ্রীযুক্ত কালিদাস ভশ্চাযকে শুধোন!); কিন্তু এক্ষেত্রে মৌলানা আমার কাছ থেকে অনাচার-সংবাদ পেলে যে ওদের কান মলে দেবেন সেই ভরসায় গেলুম।
আমার সঙ্গে আরেকটি স্পেশালিস্ট ছিলেন। বাকিরা পাকা মেম্বার। তাদের একমাত্র কামনা, কাম খতম করে বাড়ি ফেরার। বিশেষত ‘লেড়ে’র ব্যাপার– চাকরিটা মিম্বরুল্লা পেল, না মৃদম খান পেল সে নিয়ে তাদের ‘মাতাব্যাতা’ হবে কেন, ছাই!
তবু ভদ্রতার খাতিরে তাঁরা দু-একটি প্রশ্ন শুধোলেন। সে ভারি মজা। যেমন ‘আপনার মাদ্রাসায় ইংরেজিও পড়ানো হত?’– কথাবার্তা অবশ্য আংরেজিতেই হচ্ছে। কারণ প্রশ্নকর্তারা ফারসি ও ফরাসির তফাৎ জানেন না।
‘জী, হ্যাঁ।’
‘কী পড়েছেন?’
‘জী রাসকিনের “সিসেম অ্যান্ড লিলিজ”, মিলটনের “এরিয়োপেজি—”
‘শেকসপিয়র?’
‘জী।’
‘কী?’
‘হ্যামলেট’।
এবারে প্রশ্নকর্তা দারুণ উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘বাব্বা, বাব্বা! বেশ, বেশ। সুপ্রস্তাব!’
তার পর তিনি সোৎসাহে আরম্ভ করলেন, হ্যামলেটের আত্ম-আর্তনাদ– সলিলকি– “To be or not to be” তাকিয়ে আছেন কিন্তু আমার দিকে, ওমেদারের দিকে না– আমার অপরাধ? ইংরেজি খবরের কাগজেও একটা অত্যন্ত বেকার খবর বেরিয়েছে, আমার কী একটা বই কী যেন একটা প্রাইজ পেয়েছে, এবং স্বয়ং রাষ্ট্রপতি নাকি আমাকে প্রাইজটি দেবেন স্বহস্তে! আমাকেই ইমপ্রেস করা তখন তাঁর জীবন্মৃত্যুর চরম কাম্য–বলা তো যায় না, এখন থেকেই যদি রীতিমতো আমাকে তোয়াজ করে ইমপ্রেস করা যায় তবে আমি হয়তো প্রাইজ নেবার সময় কানে কানে রাষ্ট্রপতিকে বলে দেব, ‘হুঁজুরের আন্ডার-সেক্রেটারি অনন্তভূত-পরাশরলিঙ্গমকে এখন একটি প্রমোশন দেওয়া উচিতস্য উচিত!’ অবশ্য সেটা সেরকম মোকা নয়। কিন্তু বলা তো যায় না– যদি হয়েই যায়। নেপোলিয়ন (আজকালকার ‘জ্ঞানী’রা যাকে নাপোলেও বলেন, যেন আমাদের মতো সে-যুগের রাম-পন্টকরা খাঁটি উচ্চারণ জানত না বলে বাংলাতে তদনুযায়ী সঠিক বানান লিখতে পারেনি!) বলেছেন, অসম্ভব বলে কিছুই নেই। নিশ্চয়ই তিনি জানতেন, কখন কীভাবে কাকে লুব্রিকেট– তেলাতে হয়!